একসময় জ্ঞানপিপাসুদের পদচারণায় মুখর থাকা খুলনার পাইকগাছা উপজেলার একমাত্র সরকারি পাঠাগারটি এখন চরম অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার শিকার। নড়বড়ে আসবাবপত্র, ধুলোয় ঢাকা বইয়ের তাক আর ভবনের জরাজীর্ণ দশার কারণে এখন পাঠকরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহ ও তদারকির অভাবে কেবল নামেই টিকে আছে একসময়ের এই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রটি, যা দ্রুত সংস্কার ও আধুনিকায়ন না হলে অচিরেই বিলুপ্তির পথে যাবে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পাঠাগারে হাতে গোনা কয়েকটি টেবিল-চেয়ার ও আলমারি ছাড়া বাকি সব আসবাবপত্রের অবস্থা ভঙ্গুর। নতুন কোনো বই নেই। ধুলোবালি আর অযত্ন অবহেলায় রয়েছে পাঠাগার। দেওয়ালের রঙ চটা অবস্থা আর বিভিন্ন স্থানে ধরেছে ফাটল। পাঠাগারের ভবন ফেটে পানি পড়ে এবং জানালা-দরজাও প্রায় সব ভাঙা অবস্থায় রয়েছে।
‘কয়েক বছর আগেও এই লাইব্রেরিতে বহু ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করার জন্য আসতো। এখন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, স্যোশাল মিডিয়া, নতুন বইয়ের কালেকশন, প্রচার প্রচারণা এই লাইব্রেরিতে না থাকার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে পাঠাগারের গুরুত্ব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় উপজেলার এই পাঠাগারে বই পড়তে ভিড় জমাতেন ছাত্র-ছাত্রী, চাকরিপ্রার্থী ও সাধারণ পাঠকরা। এখন মাত্র হাতে গোনা ৫-৬ জন চাকরি প্রত্যাশী এই লাইব্রেরিতে আসেন। পূর্বে স্থানীয় ও জাতীয় অনেক পত্রিকা রাখা হতো। কিন্তু এখন পত্রিকাও আসে না। শিক্ষার্থীদের আনা গোনাও অনেকটা কমে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে পাঠাগারটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এক সময়ের পাইকাগাছা উপজেলার জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র এখন কেবল নামেই টিকে আছে। কিন্তু এমন বেহাল অবস্থায় থাকলে আর কিছুদিন পর পাঠাগারের নাম মানুষ ভুলে যাবে। প্রত্যেক বছর এই পাঠাগারের জন্য সরকার কর্তৃক একটি বাজেট দেওয়ার কথা থাকলেও আদৌ কাজ হয় না।
আরও পড়ুন
নারায়ণগঞ্জে আলো ছড়াচ্ছে সুধীজন পাঠাগার
অবহেলায় মৃতপ্রায় ফরিদপুরের কোহিনুর লাইব্রেরি
স্থানীয় বাসিন্দা বিজয় সানা জানান, কয়েক বছর আগেও এই লাইব্রেরিতে বহু ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করার জন্য আসতো। এখন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, স্যোশাল মিডিয়া, নতুন বইয়ের কালেকশন, প্রচার প্রচারণা এই লাইব্রেরিতে না থাকার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে পাঠাগারের গুরুত্ব।
তিনি আরও বলেন, পাঠাগারকে সচল করতে হলে অবিলম্বে ভবন সংস্কার, নতুন বই সংযোজন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা চালু করতে হবে নইলে তরুণ প্রজন্ম বই থেকে আরও দূরে সরে যাবে।
‘পাঠাগারের কার্যক্রম পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। পাঠাগার কেবল বই রাখার স্থান নয়, এটি মানুষের চিন্তা চেতনা ও মানবিকতার বিকাশের জায়গা। উপজেলার পাঠাগারের অবস্থা উন্নয়নের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনের নতুন বই, আসবাবপত্র, ডিজিটাল সুবিধার সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। যাতে তরুণরা বইয়ের গন্ধে ফিরে আসে। পাশাপাশি পাঠাগারটি সিসি ক্যামেরার আওয়াতায় এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হবে।’
শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান তৌফিক বলেন, বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের বেশি আগ্রহী। ফলে প্রযুক্তিহীন লাইব্রেরির কদর কমে গেছে। ডিজিটাল লাইব্রেরি থাকলে পাঠক সহজেই ই-বুক প্রবন্ধ ও গবেষণা ডাটাবেজ ব্যবহার করতে পারতো। এছাড়াও তথ্য সংগ্রহের অনেক সময় নষ্ট করতে হয়। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি থাকলে সময় কম লাগে।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার একটি আধুনিক লাইব্রেরির অপরিহার্য অংশ। শিক্ষা গবেষণায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অবিলম্বে লাইব্রেরির ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ জরুরি। একই সঙ্গে বই সংরক্ষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। বই পড়লে মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
চাকরি প্রত্যাশী শিক্ষার্থী তানজিলা আক্তার বলেন, একটি উপজেলায় লাইব্রেরি থাকলে অনেক গরীব শিক্ষার্থী লাইব্রেরি থেকে পড়াশোনা করতে পারেন। অনেকের বই ক্রয়ের সামর্থ্য নেই, যার কারণে অনেক সময় তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তবে উপজেলার লাইব্রেরিতে নতুন নতুন বইয়ের সংগ্রহ থাকলে সকলে সুবিধা পাবেন।
আরও পড়ুন
সেলুনে পাঠাগার, অপেক্ষার সময় কাটবে বই পড়ে
শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বৃত্তি দিলো সেলিম আল দীন পাঠাগার
পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, উপজেলার এই পাঠাগারটি এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সর্বপ্রথম পাঠাগার সংস্কার করতে হবে। পাঠাগারে বর্তমানে পাঠকের সংখ্যা নেই বললে চলে। একটা সময় দেখেছি এই পাঠাগারে পাঠকরা ভিড় জমাতেন।
তিনি আরও বলেন, উন্নত প্রযুক্তির যুগে এখন সবার কাছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকায় পাঠাগারে আসার আগ্রহ অনেকের নেই বললেই চলে। ইচ্ছা করলে ফোনের মাধ্যমে সব দেখতে পায়। তবে পাঠাগার সংস্কার ও আধুনিকায়ন করলে পাঠকরা আকৃষ্ট হবে। একটা সময় দেখেছি সেখানে অনেক পত্রিকা পাওয়া যেতো। পাঠকরা পত্রিকা ও চাকরি প্রত্যাশীরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখতেন পাঠাগারে এসে। কিন্তু এখন বন্ধ রয়েছে সব। দু-একটা পত্রিকা নেওয়া হয় লাইব্রেরিতে। সব ধরনের পত্রিকার ব্যবস্থা করতে হবে ও নতুন নতুন বই যোগ করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে আবারো পাঠকরা এই লাইব্রেরিতে আসবেন।
এ বিষয়ে কথা হয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যুৎ রঞ্জন সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি অনেক আগে দেখেছি এই লাইব্রেরিতে অনেক পাঠক আসতো কিন্তু এখন মাত্র কয়েকজন পাঠক আসেন। এখন কেন পাঠকরা এই লাইব্রেরিতে কম আসেন, তা আমাদের আগে খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়াও পাঠকের চাহিদা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এখন উন্নত প্রযুক্তির যুগে সব কিছু মানুষ খুব সহজেই মোবাইল, কম্পিউটারে দেখতে পাচ্ছেন। পাঠকরা চাইলে তারা মুহূর্তের মধ্যে গুগলের মাধ্যমে সার্চ করে পড়তে পারেন। এই লাইব্রেরিতে যদি ডিজিটাল সিস্টেমের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের জন্য সুবিধা হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি নতুন নতুন বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
পাইকগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন বলেন, আমরা পাঠাগারের কার্যক্রম পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। পাঠাগার কেবল বই রাখার স্থান নয়, এটি মানুষের চিন্তা চেতনা ও মানবিকতার বিকাশের জায়গা। উপজেলার পাঠাগারের অবস্থা উন্নয়নের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনের নতুন বই, আসবাবপত্র, ডিজিটাল সুবিধার সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। যাতে তরুণরা বইয়ের গন্ধে ফিরে আসে। পাশাপাশি পাঠাগারটি সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হবে।
এমএন/জিকেএস