আইফেল টাওয়ার: প্রেম, সংস্কৃতি আর স্থাপত্যের বিস্ময়

11 hours ago 10

প্যারিস, যেন স্বপ্নে ভেসে থাকা এক শহর। কেউ বলে ভালোবাসার নগরী, কেউ বলে শিল্প-সংস্কৃতির রাজধানী। এই শহরের মাঝখানে আকাশচুম্বী এক স্থাপনা- আইফেল টাওয়ার, যা আজ শুধু ফ্রান্স নয়, সমগ্র পৃথিবীর রোমান্স, সৌন্দর্য ও উদ্ভাবনের প্রতীক।

কয়েকদিন আগে সরাসরি ঘুরে দেখলাম এই অনন্য স্থাপত্য। টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল- যেন ইতিহাস, প্রেম আর প্রকৌশল একাকার হয়ে গেছে। প্রতিটি লোহার বাঁকে আছে একশ ত্রিশ বছরের গল্প, প্রতিটি আলোর ঝলকে আছে মানব সভ্যতার অর্জনের দীপ্তি।

jagonews24

ইতিহাসের পাতায় জন্ম এক বিস্ময়ের
১৮৮৯ সালে ফ্রান্সে আয়োজিত বিশ্বমেলার মূল আকর্ষণ হিসেবে তৈরি করা হয় আইফেল টাওয়ার। ফরাসি প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেল-এর নকশায় গড়ে ওঠা এই টাওয়ার প্রথমদিকে প্যারিসবাসীর কাছে তেমন জনপ্রিয় ছিল না। অনেকেই একে ‘লোহার দৈত্য’ বলে বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই সমালোচনাই পরিণত হয় শ্রদ্ধায়, আর আইফেল টাওয়ার হয়ে ওঠে ফরাসি গর্বের প্রতীক।

jagonews24

প্রায় ১০ হাজার টন লোহা ও ২৫ লাখ রিভেট দিয়ে তৈরি এই টাওয়ারের উচ্চতা ৩৩০ মিটার। ১৯৩০ সালে নিউইয়র্কের ক্রাইসলার বিল্ডিং তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এটিই ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থাপনা।

নির্মাণের পেছনের গল্প
নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৮৭ সালে। দুই বছর পাঁচ মাসে ৩০০ জন শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে যায় টাওয়ারটি। কোনো আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই, কেবল ম্যানুয়াল যন্ত্রপাতি ও ধাতব কাঠামোর সমন্বয়ে তৈরি হয় এই প্রকৌশল বিস্ময়। আজও টাওয়ারটি প্রতি সাত বছর পরপর নতুন করে রঙ করা হয়। এতে লাগে প্রায় ৬০ টন রং!

দিনে ভিন্ন, রাতে ভিন্ন সৌন্দর্য
দিনের আলোয় আইফেল টাওয়ারের রূপ অন্যরকম। সূর্যের আলোয় চকচকে লোহার কাঠামো যেন শক্তি ও স্থিতির প্রতীক। কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে যখন টাওয়ারজুড়ে জ্বলে ওঠে লাখো আলো, তখন পুরো প্যারিস শহরই যেন নতুন এক রূপকথায় ঢেকে যায়।

jagonews24

সন্ধ্যায় দেখা যায় চারপাশে ভিড়- কেউ প্রেমিকাকে ফুল দিচ্ছে, কেউ আবার পরিবারের সঙ্গে ছবি তুলছে। রাত ৮টা বাজতেই টাওয়ারে জ্বলে ওঠে ‌‘স্পার্কলিং লাইট’- ঠিক পাঁচ মিনিটের সেই দৃশ্য দর্শকদের মুগ্ধতায় স্তব্ধ করে দেয়। মনে হয়, স্বপ্নের কোনো পরী নগরী চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

টাওয়ারের তিন তলায় তিন অভিজ্ঞতা
আইফেল টাওয়ারে আছে তিনটি দর্শনীয় স্তর। টিকিট কেটে লিফটের মাধ্যমে উঠা যায় ওপরে। প্রথম তলায় রয়েছে রেস্তোরাঁ ও প্রদর্শনী গ্যালারি। কাচের মেঝে দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যায় পর্যটকদের ভিড়- নিচে ছোট ছোট মানুষ, ওপরে মহাকাশ ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা। দ্বিতীয় তলা থেকে দেখা যায় প্যারিসের বিখ্যাত সব স্থাপনা- নটরডেম ক্যাথেড্রাল, লুভর মিউজিয়াম, আর্ক দে ত্রিয়ম্ফ, সেঁইন নদীর তীর। আর সর্বোচ্চ তলায় পৌঁছে নিচে তাকালে মনে হয় পুরো ফ্রান্স যেন হাতের তালুতে ধরা।

প্যারিসের হৃদয়ে এক অনন্ত প্রেম
আইফেল টাওয়ার শুধু লোহার গাঁথুনি নয়- এটি ফরাসি জাতির আত্মমর্যাদা, সংস্কৃতি ও প্রেমের প্রতীক। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকা আসে তাদের ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিতে। অনেকে তালা ঝুলিয়ে রাখে সেঁইন নদীর সেতুতে- বিশ্বাস, এই টাওয়ার যেমন অটুট, তেমনি থাকবে তাদের ভালোবাসাও। শিল্পী, লেখক, আলোকচিত্রী- সবাই আইফেল টাওয়ার থেকে নেয় অনুপ্রেরণা। কেউ কবিতা লেখে, কেউ ছবি তোলে, কেউ আবার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করে এখান থেকেই।

এমআরএম

Read Entire Article