আইসিইউতে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

1 hour ago 3
  • এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে অফিস করেন ভিসি
  • নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
  • সিন্ডিকেট সভায় নতুন সিদ্ধান্ত

২০১৮ সালের অক্টোবরে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়। চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও আধুনিক চিকিৎসাসেবার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিকল্পনায় ছিল বিশাল ক্যাম্পাস, আধুনিক গবেষণাগার, আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি, নার্সিং ও ডেন্টাল অনুষদ এবং এক হাজার শয্যার একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল।

কিন্তু প্রতিষ্ঠার সাত বছর পরও আলোর মুখ দেখেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে শুরুতেই হোঁচট খায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের চতুর্থ এই সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

জনবল নিয়ে জটিলতা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলাসহ নানা টানাপোড়েনের কারণে অনেকটা ‘মুমূর্ষু’ অবস্থায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনজন ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) দায়িত্ব পালন করলেও স্থায়ী ক্যাম্পাসেও যেতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। যেন কোনো ‘ওষুধেই’ কাজ করছে না। এই অবস্থার মধ্যে কর্তৃপক্ষও বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে।

বর্তমানে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে। হাসপাতালের ১০তলা ভবনের আইসিইউ বিভাগের একটি কক্ষে অফিস করেন ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল পাটওয়ারি।

আর সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে অফিস করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ডা. জিয়াউর রহমান। তিনি ওই কলেজের অধ্যক্ষ।

নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে সকল সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সেখানে অফিস করেন না ভিসি থেকে শুরু করে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে করে নষ্ট হচ্ছে অনেক দামি জিনিস। তাছাড়া নিয়ম বহির্ভূতভাবে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন ভিসি।

অবশ্য ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল পাটওয়ারি বলছেন, অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কাজের কোনো পরিবেশ নেই। আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা ক্ষোভ রয়েছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গেলে তাদের তোপের মুখে পড়তে হতে পারে, তাই এখানে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

শুরুতেই নিয়োগ কেলেঙ্কারি

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (অর্থ) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় নঈমুল হক চৌধুরীকে। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। নঈমুল হক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

প্রতিষ্ঠার বছরখানেক পরই এই দুই কর্তার হাত ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শুরু হয় নজিরবিহীন অনিয়ম। অনুমোদন ছাড়াই প্রায় ২২০ জনকে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে তদন্তে নামে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। পরে দুদকও তদন্ত শুরু করলে প্রাথমিক সত্যতা পায়। দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক উপাচার্য, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল ৫৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। দুদকের সেই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করতে গেলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জেলহাজতেও পাঠান আদালত।

আরও পড়ুন
সিলেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে চর্মরোগ ‌‘স্ক্যাবিস’ 
‘গায়েবি গ্যারান্টর’ বানিয়ে ব্যবসায়ীকে ফাঁসানোর অভিযোগ 
খোলস পাল্টে বহাল তবিয়তে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, তালিকায় দায় সেরেছে সিসিক 

দুদকের মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ অভিযোগ আমলে নিয়ে ইউজিসি ২০২৩ সালে তদন্ত করে। তদন্তে তৎকালীন উপাচার্য মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. নঈমুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যায়। পরে দুদকের সিলেটের সমন্বিত জেলা কার্যালয় নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন উপাচার্য, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারসহ ৫৮ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল মামলা করে। চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল ৫৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে সিন্ডিকেট ও ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২২০ জনকে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে (অ্যাডহক) ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে মেয়াদ অনূর্ধ্ব ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি নিয়মিত না করে আবার অ্যাডহকে দুই থেকে পাঁচবার পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

স্থবির প্রশাসন, ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

নিয়োগে নজিরবিহীন অনিয়মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে স্থবিরতা দেখা দেয়। তাছাড়া দুদকের মামলার আসামি হওয়ায় অনেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন। আর যাদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো অনিয়মের প্রমাণ পায়নি, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করলেও কার চাকরি আছে, কার নেই তা বুঝে ওঠা দায়।

এ অবস্থায় দেড় বছর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা ছাড়াই অফিসে আসা-যাওয়া করেন। কিন্তু অভিভাবকহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ না থাকায় আড্ডা-গল্পে কর্মঘণ্টা কাটান তারা। সর্বশেষ ২৪’র ৫ আগস্টের পরও অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু নিয়োগ জটিলতার কোনো সুরাহা না হওয়ায় প্রায় এক বছর ধরে কেউই ক্যাম্পাসে যান না।

সিন্ডিকেট সভায় নতুন তিন সিদ্ধান্ত

শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ১৩তম সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে বিগত ১১তম সিন্ডিকেটে গঠিত নিয়োগ কমিটি যাদেরকে সুপারিশ করেছে তাদের তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বরাবর পাঠানো, ৭৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বয়স প্রমার্জনের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রারম্ভিক পর্যায়ে যোগদানের ক্ষেত্রে যাদের বয়স ৩০ ছিল তাদের ক্ষেত্রে প্রমার্জনের বিষয়টি বিবেচনার প্রস্তাব এবং হাইকোর্টে যে সকল পদে রিট করা হয়েছে, সেসকল পদ ব্যতিরেকে নতুন করে ৩২টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অগ্রগতি ও জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে সিন্ডিকেট সভায় অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কথা। কিন্তু ভিসি কতটুকু কাজ করছেন, সেটা তিনি ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না।

পুরোনো নিয়োগ বাতিল, নতুন করে হবে নিয়োগ

শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জটিলতা নিরসনের অগ্রগতি বা পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল পাটওয়ারি জাগো নিউজকে বলেন, আগের সব নিয়োগ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অনুমোদন দিলে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তিনি বলেন, আগে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স রয়েছে, তাদের বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। তিনি বিবেচনা করলে যারা আগে কাজ করতো, তাদের বিষয়টা দেখা হবে।

হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে দাপ্তরিক কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কাজের পরিবেশ নেই, সব ভাঙচুর করা হয়েছে। আগে যারা আন্দোলনরত ছিল, সবসময় তাদের তোপের মুখে পড়তে হয়। এজন্য সেখানে কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। নতুন করে কোথাও ক্যাম্পাস পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখা হচ্ছে।

এফএ/জিকেএস

Read Entire Article