‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়/ধূলির ধরা বেহেশতে আজ, জয় করিল দিলরে লাজ/আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।’ বিশ্ননবি ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) ভালোবাসায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কতই না চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তার অভিব্যক্তি। আসলে বিশ্বনবীর আগমন ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ।
এই মহান রাসুল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা এই ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘আর আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সুরা সাবা: ২৮)।
শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অতুলনীয় জীবনাদর্শ অবলম্বনই আমাদের একমাত্র মুক্তির পথ। তিনি (সা.) সব বিষয়ে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন। প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয়ে মহানবি (সা.) বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। মহানবি (সা.) বলেছেন, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করা অনেক বড় একটি নৈতিক গুণ। হজরত জিব্রাঈল (আ.) সর্বদা আমাকে প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করার তাগিদ দিয়েছেন, এমনকি আমার ধারণা হয়, সে তাকে আবার উত্তরাধিকারীই না বানিয়ে দেয়। প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব এত বেশি।
এরপর রয়েছে শাসকের আনুগত্য। এ সম্পর্কে তিনি সবসময় তাগিদ দিয়েছেন আর বলেছেন, শাসকের আনুগত্য করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য আর উন্নত নৈতিকতার এটিই দাবি আর সুনাগরিকের হওয়ার দাবি হল, নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আনুগত্য কর। যদি কোনো কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসও তোমাদের আমির নিযুক্ত হয় তাহলে তার আনুগত্য কর, এরপর যে দেশে বসবাস করছ, যেখানকার নাগরিক, সেদেশকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলেছেন, ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। এজন্য যেখানে এই নৈতিক চরিত্রের দাবি হল, নিজ কর্মকর্তাদের আনুগত্য করা আর স্বদেশকে ভালোবাসা সেখানে স্মরণ রেখ, এ বিষয়গুলো ইমানের অঙ্গও বটে। এজন্য একজন মুসলমানকে, যে দেশেই সে বসবাস করুক না কেন- দেশীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রেখে বসবাস করা উচিত।
মহানবি (সা.) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে যখনই কোনো জাতির কোনো সম্মানিত ব্যক্তি আসবে তাকে সম্মান করো’ (জামিউল মাসানিদ ওয়াল সুনান, ৮ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৩)
হজরত রাসুল করিম (সা.) সম্পর্কে একথা প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি কোনো জাতির দূতকেই কোনরূপ কষ্ট দিতেন না। (সহিহ বোখারি) বরং তিনি তার শেষ দিনগুলোতে ওসিয়্যত হিসেবে এই তাগিদ দিয়েছিলেন, তোমাদের কাছে যখনই কোনো জাতির কোনো প্রতিনিধি আসেন তখন তাকে উপহার-উপঢৌকন ইত্যাদি দিও, যেভাবে আমি দিয়ে থাকি। (সহিহ বুখারি)
মহানবি (সা.) বিশ্ববাসীর সংশোধনের কাজ করেছেন। যেখানে না কোন স্কুল ছিল আর না-ই মাদ্রাসা। তিনি বাড়িতে উঠা-বসা, শয়ন-জাগরণ, কথাবার্তা বলায় এবং জ্ঞানার্জনের শিষ্ঠাচার থেকে আরম্ভ করে দেশীয় এবং জাতীয় আর পৃথিবীতে রাজত্ব করার সকল নিয়ম-নীতি অত্যন্ত স্নেহ ও ভালোবাসার সাথে শিখিয়েছেন। মক্কা-মদিনার ছোট-ছোট বাহ্যত দরিদ্র ও অনুন্নত জনবসতিতে মহানবির হাতে শিক্ষা প্রাপ্তরা নিজেদের যুগে ইরান, রোম, মিশর, সিরিয়া আর দজলা ও ফুরাত নদীর তীরে বসবাসকারীদের অজ্ঞতা ও নিষ্পেষণ সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে জ্ঞান ও তত্ত্বের এমন ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছেন যা পরবর্তীতে শত শত বছর ধরে গোটা মানবজাতিকে সরল-সুদৃঢ় পথ প্রদর্শনের কাজ করেছে।
‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের উপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকী)।
তাঁর শিষ্যরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞান, সাহিত্য এবং ধর্মীয় জগতের চিত্রই পাল্টে দিয়েছেন। বরং যদি একথা বলা হয় তাহলে তা ষোলআনা সত্য ও যথার্থ হবে যে, আজও বিশ্বে মানবীয় সম্পর্কের পবিত্রতাকে বহাল করার আর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মাঝে ভালোবাসা ও প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক গড়ার জন্য মহানবির (সা.) শিক্ষা এবং তার আদর্শ ছাড়া অন্য কোন আচরণবিধি নেই বললেই চলে।
মহানবির উপদেশাবলি সমাজে বিজ্ঞানের সূত্রের মত কার্যকর হতে দেখা যায়। যেমনটি তিনি (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাত মায়েদের পদতলে আর পিতা হলেন, জান্নাতের দ্বার।’ পিতামাতারা যদি রাতে উঠে সন্তানদের জন্য আকুতি মিনতি ভরে দোয়া করতে থাকেন তাহলে তাদের সকল দোয়া সন্তানদের জীবনে মহান বিপ্লব সাধন করে। এটিই সবচেয়ে মূল্যবান ও নিরাপদ ভাণ্ডার যা দোয়ার আকারে পিতামাতা ঊর্ধ্বলোকে জমা করতে থাকেন যা পরবর্তীতে নিজ নিজ সময়ে সন্তানদের কাজে আসতে থাকে। এরপর তিনি (সা.) বলেছেন, সন্তানদের সম্মান কর আর তাদের তরবিয়ত করার সময় তাদের আত্মমর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখো।
এখন সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার সময় যদি তাদের আত্মসম্মানের প্রতি খেয়াল রাখা না হয় তাহলে ভালো ভালো কথা এবং সর্বোত্তম উপদেশও তাদের ধ্বংসের গহ্বরে নিক্ষেপের কারণ হয়ে যায়। এরপর তিনি (সা.) বলেছেন, সালামের প্রচলন কর, ক্ষুধার্তকে আহার করাও আর সমাজ থেকে ক্ষুধাকে নির্মূল কর যা বিভিন্ন প্রকার অপরাধের মূল কারণ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার কর। রাতের বেলা এমন সময় উঠে নামাজ পড় যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
এটি এমন একটি উপদেশ যা প্রত্যেক বাড়িকে এবং প্রতিটি শহরকে শান্তির নীড়ে পরিণত করতে পারে। বাহ্যত তাঁর ছোট-ছোট কথা তা যদি শিশুকাল থেকেই আদর-ভালোবাসা ও স্নেহের সাথে বারবার কর্ণগোচর হতে থাকে তাহলে সেই শান্তি যার সন্ধানে শিশু-বৃদ্ধ, যুবক, নারী-পুরুষরা ঘরের বাইরে রাস্তা-ঘাটে এবং অলিগলিতে আর বিভিন্ন ক্লাবে ঘুরে বেড়ায় সেই শান্তি তারা বাড়িতেই পেয়ে যাবে।
চামড়ার রং, ধন-সম্পদের পরিমাণ, সামাজিক মর্যাদা, বংশ ইত্যাদির দ্বারা মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন হতে পারে না। মর্যাদা ও সম্মানের সঠিক মাপকাঠি হলো ব্যক্তির উচ্চমানের নৈতিক গুণাবলি এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা। বিশ্বমানব একটি পরিবার বিশেষ। জাতি, উপজাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির বিভক্তি কেবল পরস্পরকে জানার জন্য, যাতে পরস্পরের চারিত্রিক ও মানসিক গুণাবলি দ্বারা একে অপরের উপকার সাধিত হতে পারে।
হজরত রাসুল করিম (সা.) সব সময় সাহাবায়ে কেরামকে (রা.) নম্র ও সুন্দর ব্যবহারের উপদেশ দিতেন। অযথা ক্রোধ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন। তিনি (সা.) মানুষকে সাবধান করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নম্র ও বিনয়ী হয় আল্লাহ তাকে উচ্চাসনে আসীন করেন আর যে অহংকারী হয় আল্লাহ তাকে অপদস্থ করেন।’ (মিশকাত)
মহানবি (সা.) এর মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজ্জের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি ( সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের উপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ’ (বায়হাকী)।
এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতি-মালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা-বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা-ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে শ্রেষ্ঠনবির (সা.) আদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/এমএস