‘আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে দুটিতে সুখবর আছে। বাকি দুটিতে অনিশ্চয়তা।’
নতুন বছরে দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
জাগো নিউজ: চলতি বছর অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি কেমন হবে?
ড. জাহিদ: ২০২৫ সাল বাংলাদেশের জন্য একটি অনিশ্চয়তার বছর হতে পারে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের শেষ দিকে নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচন কেন্দ্র করে যদি কোনো ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয় বা ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ঘাটতি হয় তাহলে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও দেশের ব্যবসায়িক বিষয়গুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে।
জাগো নিউজ: কীভাবে আন্তর্জাতিক বিষয় বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রভাবিত করতে পারে?
ড. জাহিদ: আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে দুটিতে সুখবর আছে। বাকি দুটিতে অনিশ্চয়তা।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিষফোড়া ব্যাংক ও জ্বালানি খাত। আর্থিক ও জ্বালানি খাতের সংস্কারের পাশাপাশি বিজনেস রেগুলেশনের স্ট্যান্ডারাইজ করতে হবে
প্রথমত, বৈশ্বিক বাজারে সুদের হার কমতে শুরু করেছে, যা বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুদের হার ৫ দশমিক ৩ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য ও শিল্পের কাঁচামালের দাম কমার ইঙ্গিত রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর।
খারাপ খবর হলো ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন হলো দাম বাড়লে সেটা কি স্থায়ী হবে নাকি কমবে? যদি কমে তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো। যদি বেড়ে যায় তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না, কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যেতে পারে, যা মানুষের জন্য কষ্টকর হবে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে।
- আরও পড়ুন
- সংস্কারও নয়, পরিবর্তন আনতে হবে: আশিকুর রহমান
- ‘দুষ্টচক্রে’ অর্থনীতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই বড় চ্যালেঞ্জ
- পুঁজিবাজারে আশা সঞ্চার হওয়ার মতো পদক্ষেপ দেখছি না
- প্রতিটি শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে হবে
জাগো নিউজ: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ কী ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করতে পারে?
ড. জাহিদ: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বে একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করা সম্ভব। অর্জন করতে হলে প্রথমে ঘর ঠিক করতে হবে অর্থাৎ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। কারণ ব্যবসায়ীরা দেখতে চান তার কারখানা চলবে কি না এবং বিনিয়োগ নিরাপদ কি না।
রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে; যাতে তারা সংস্কার শেষ করে যথাসময়ে নির্বাচন দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখতে পারে
জাগো নিউজ: ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী, যা দ্রুত মোকাবিলা করতে হবে?
ড. জাহিদ: এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিষফোড়া ব্যাংক ও জ্বালানি খাত। আর্থিক ও জ্বালানি খাতের সংস্কারের পাশাপাশি বিজনেস রেগুলেশনের স্ট্যান্ডারাইজ করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে ও বর্তমান উৎপাদন সচল রাখতে ব্যাংকখাত স্থিতিশীল করা এবং শিল্পে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা এটি করতে না পারি তাহলে কর্মসংস্থান আটকে যাবে। এটি সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি আরও কমপক্ষে ১২ মাস থাকে এবং তারা যে সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো যদি কিছুটা হলেও শেষ করে বাস্তবায়নের দিকে এগোতে পারে তাহলে ব্যবসায়ীদের কনফিডেন্স ফিরবে এবং সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ফলে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
২০২৫ সালে বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ব্যাংকখাত সুচারুরূপ দিতে হলে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।
সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য রাজস্ব খাত আরও গতিশীল করতে হবে। যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে, তা না হলে ব্যবসায়ীরা জটিল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হবে না। সরকারও তার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাবে না।
জাগো নিউজ: ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানিতে?
ড. জাহিদ: বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে আমেরিকায় নতুন করে ট্রাম্পের শপথ নেওয়া এবং তার ট্যারিফ পলিসির প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক বাণিজ্যে। সেটা একদিকে যেমন ভালো ইঙ্গিত রয়েছে বাংলাদেশের জন্য, ঠিক তেমনিভাবে খারাপও হতে পারে। যদি ট্রাম্প প্রশাসন চায়নাসহ অন্য দেশের ওপর বেশি হারে শুল্ক আরোপ করে তাহলে সেখান থেকে ব্যবসা শিফট হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়বে এবং বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকবে।
অন্যদিকে, অতি শুল্কের কারণে যদি একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয় কিংবা বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে গ্লোবাল ব্যবসাকে সংকুচিত করতে পারে। যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিতেও পড়তে পারে।
জাগো নিউজ: অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে রাজনীতিবিদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
ড. জাহিদ: অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকে তাহলে ২০২৫ সালে অর্থনৈতিক অবস্থা অনিশ্চয়তার দিকে যেতে পারে।
তবে আশার কথা হলো- যে সব সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের কমিটি গঠিত হয়েছে তারা যেভাবে কাজ করছেন সে সব কাজের ফলাফল যদি ২০২৫ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় কোয়ার্টারে দৃশ্যমান হয় তাহলে সেটা ভালো ফল বয়ে আনতে পারে।
সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও বর্তমান সরকারের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহায়তা না করে তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও যে ধরনের সংস্কার নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং তার ফল জাতিকে উপহার দেওয়া কঠিন হবে।
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে; যাতে তারা সংস্কার শেষ করে যথাসময়ে নির্বাচন দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখতে পারে।
আইএইচও/এএসএ/জিকেএস