বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদ আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। চট্টগ্রামের এ মসজিদটি কেবল ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক। ১৬৬৭ সালে মুগল আমলে প্রতিষ্ঠিত এ মসজিদ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসল্লিদের ইবাদতের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং মুসল্লিদের প্রয়োজন অনুযায়ী সুবিধা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
বর্তমান সরকার মসজিদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে তাকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে আর্কিটেক্টস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (আইএবি) আয়োজিত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন স্থাপত্য নকশা নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মূল মসজিদের স্থাপত্য রীতি ঠিক রেখে এর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
এ প্রবন্ধে আমরা আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সম্প্রসারণ প্রকল্পের নকশা ও পরিকল্পনা, এবং আধুনিকায়নের ফলে মুসল্লিদের কী কী সুবিধা হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
মুঘল আমলে বাংলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর সুবেদার শায়েস্তা খানের সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খান এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি মুগল স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল নিদর্শন। মসজিদটি তার স্বতন্ত্র গম্বুজ, খিলান, এবং কারুকাজ খচিত মিনার দ্বারা সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
এ মসজিদ শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও অংশ। ঐতিহাসিক দলিল অনুসারে, মসজিদের প্রাঙ্গণ একসময় প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বিশেষত, ব্রিটিশ আমলে এই স্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ, ঈদের নামাজসহ বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে মুসল্লিদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং জায়গার সংকট দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে জুমা ও ঈদের নামাজের সময় অতিরিক্ত মুসল্লির জায়গার অভাবে রাস্তার পাশে নামাজ আদায় করতে হয়।
এ ছাড়া মসজিদটির অভ্যন্তরীণ কাঠামোও সময়ের সাথে কিছুটা পুরোনো হয়ে পড়েছে। আলো-বাতাস প্রবাহ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, ওজুখানা, মহিলাদের নামাজের স্থান, লাইব্রেরি ও ইসলামিক গবেষণা কেন্দ্রের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধার অভাব রয়েছে।
তাই সরকার মূল স্থাপত্য ঠিক রেখে এই মসজিদের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে এটি একদিকে ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে থাকে, অন্যদিকে আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ হয়।
নতুন নকশা ও পরিকল্পনা
সরকার মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য আর্কিটেক্টস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (আইএবি) এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে বিভিন্ন স্থপতি ও প্রকৌশলী অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের নকশা জমা দেন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বোত্তম নকশা নির্বাচন করা হয়েছে, যা মসজিদের মূল রূপ অক্ষুণ্ন রেখে আধুনিকতার ছোঁয়া দেবে।
প্রস্তাবিত পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য
মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি : বর্তমানে মসজিদটিতে ১৫০০ জন মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। সম্প্রসারণের পর এটি ৮০০০ মুসল্লির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন হবে।
বিশেষ মহিলা নামাজ কক্ষ : নারী মুসল্লিদের জন্য আলাদা নামাজের জায়গা সংযোজন করা হবে।
উন্নত অজুখানা ও শৌচাগার : আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন ওজুখানা ও শৌচাগার তৈরি করা হবে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নামাজ কক্ষ : সারাবছর আরামদায়ক নামাজের জন্য পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং সুবিধা রাখা হবে।
বই ও গবেষণা কেন্দ্র : ইসলামি গবেষণা ও পাঠাগার স্থাপন করা হবে, যেখানে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, এবং ইসলামি ইতিহাস বিষয়ক বই থাকবে।
ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম : আজানের শব্দ সুস্পষ্টভাবে পৌঁছানোর জন্য উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেম বসানো হবে।
সৌরশক্তি ব্যবহার : মসজিদের বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার ব্যবস্থা থাকবে।
বিশাল প্রাঙ্গণ ও পার্কিং সুবিধা : মুসল্লিদের যানবাহন রাখার জন্য আলাদা পার্কিং এলাকা নির্ধারণ করা হবে।
বুয়েটের সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত দিক : এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রযুক্তিগত দিক থেকে সহযোগিতা করবে। বুয়েটের স্থাপত্য ও প্রকৌশল বিভাগের বিশেষজ্ঞরা মসজিদের নকশা, নির্মাণ উপাদান, এবং ভূমিকম্প-সহনশীল কাঠামোর বিষয়ে পরামর্শ দেবেন।
তারা বিশেষভাবে নিশ্চিত করবেন, মূল মসজিদের ঐতিহ্য নষ্ট না হয়। মসজিদে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস পর্যাপ্ত প্রবাহিত হয়। নির্মাণকাজ পরিবেশবান্ধব হয়। বুয়েটের গবেষণাগারে মসজিদের কাঠামোগত বিশ্লেষণ করা হবে, যাতে এটি ভূমিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনশীল হয়।
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব : এই উন্নয়ন প্রকল্প শুধু স্থাপত্যগত উন্নয়ন নয়, এটি ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার : গবেষণা কেন্দ্র ও লাইব্রেরি স্থাপনের ফলে কোরআন-হাদিস চর্চা বাড়বে।
নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি : আলাদা নামাজের স্থান থাকায় নারীরা নিরাপদে ইবাদত করতে পারবেন।
পরিবেশবান্ধব মসজিদ : সৌরশক্তি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুতের খরচ কমবে এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণ নিশ্চিত হবে।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি একদিকে মসজিদের প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণ করবে, অন্যদিকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মুসল্লিদের ইবাদতের অভিজ্ঞতা উন্নত করবে।
সরকার, বুয়েট এবং আইএবি’র যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মুসলমানদের জন্য এটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা, প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে এবং আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ একটি আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক স্থাপনায় পরিণত হবে।
আল্লাহ আমাদের এই মহৎ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন
salamjudge@gmail.com