মওলবি আশরাফ
এরিত্রিয়ার বন্দরনগরী মাসাওয়ার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য ঐতিহাসিক স্থাপনা—মসজিদুস সাহাবা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে রাসুলের (সা.) সাহাবিগণ যখন মক্কার নির্যাতন থেকে বাঁচতে হিজরত করে হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়া ও এরিত্রিয়া) যান, তখন এ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণেই কেউ কেউ একে আফ্রিকার প্রথম মসজিদ বলে মনে করেন, যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে এটি ইসলামি ঐতিহ্যের এক মূল্যবান অংশ।
ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
মক্কার কাফিররা যখন মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে, তাদের জন্য স্বাভাবিক জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন রাসুল (সা.) তাদের নির্দেশ দেন, ‘তোমরা হাবশায় চলে যাও, এটাই তোমাদের জন্য ভালো। কারণ সেখানে একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ আছেন, যার রাজত্বে কেউ জুলুমে শিকার হয় না। সেই দেশটা সত্য ও ন্যায়ের দেশ। আল্লাহ যতদিন পর্যন্ত তোমাদের জন্য এই জুলুম থেকে বাঁচার পরিবেশ না করে দেন, ততদিন পর্যন্ত তোমরা সেখানে থাকতে পারো। (সিরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৪)
এই নির্দেশ পেয়ে হযরত ওসমান ইবনে ইবনে মাযউনের (রা.) নেতৃত্বে বারো জন পুরুষ ও চার জন নারী সাহাবি মক্কা ছেড়ে সমুদ্রপথে আফ্রিকার দিকে রওনা দেন, যা ইতিহাসে ‘হাবশায় প্রথম হিজরত’ নামে প্রসিদ্ধ। তারা খ্রিষ্টান রাজা নাজাশি শাসিত আকসুম রাজ্যে পৌঁছান। ধারণা করা হয়, মাসাওয়ার উপকূলের ছোট দ্বীপ রাস মেদরে সাহাবিগণ নোঙর ফেলেন। এখানে তারা নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেন এবং আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ গড়ে তোলেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক রিচার্ড জে. রিড মনে করেন, হয়ত ৬২০–৬৩০ খ্রিষ্টাব্দেই এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, এবং রাসুলের (সা.) সাহাবিদের কয়েকজন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
মসজিদুস সাহাবা মূলত একটি খোলা নামাজঘর, অবকাঠামো বলতে আছে কেবল একটি মিহরাব ও চার ধাপের মিম্বর। মসজিদটি প্রায় ৩,১০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এবং গত শতাব্দীর সংস্কারের পর এর সামনে এক বিস্তীর্ণ পাকা প্রাঙ্গণ তৈরি হয়েছে যা নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য দুই কেবলা—একটি জেরুসালেমের আল আকসার দিকে, অন্যটি মক্কার মসজিদুল হারামের দিকে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকে একে ইসলামের প্রথম মসজিদ কুবার সমসাময়িক মনে করেন।
তবে বর্তমানে যে অবকাঠামো দেখা যায়, তা অনেক পরে নির্মিত। কারণ বক্রাকার মিহরাব তৈরির প্রচলন শুরু হয়েছে উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজের যুগে, আর মিনার নবম শতকে। স্থাপত্য গবেষকরা মনে করেন, এই মসজিদটির বর্তমান স্থাপত্য নকশার সঙ্গে আশেপাশের আরও কিছু মসজিদের মিল আছে, বিশেষত উসমানি আমলে নির্মিত শেখ হাম্মালি মসজিদের সঙ্গে। তাই বর্তমান অবকাঠামো উসমানি আমলের কোনো এক সময় নির্মিত বলে মনে করা হয়।
ঐতিহ্য ও তাৎপর্য
যদিও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত নয় যে এটি আফ্রিকার প্রথম মসজিদ, তবু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে মসজিদুস সাহাবা এক অবিচ্ছেদ্য আধ্যাত্মিক প্রতীক। এটি শুধু নামাজের জায়গা নয়, বরং ইসলামের প্রথম যুগের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের স্মারক। মুসলমানদের হিজরতের ইতিহাসে হাবশার যে অধ্যায় রয়েছে, এই মসজিদ সেই অধ্যায়ের জীবন্ত দলিল হয়ে আজও টিকে আছে।
ওএফএফ