আয়-রোজগারে ভাটা, আতঙ্ক কাটছে না বাড্ডাবাসীর

1 month ago 12

বয়সের ভারে ন্যুব্জ বরকত বিশ্বাস। ফেরি করে বিক্রি করেন চা, পান, সিগারেট। থাকেন রাজধানী বাড্ডার ময়নারবাগ আল-আকসা মসজিদ গলিতে। গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড এলাকায় রোজ বিকেলে ঘুরতেন। গত এক সপ্তাহেরও বেশি তিনি আর মূল রাস্তার ধারের-কাছেও যান না। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় বরকতের মন-মস্তিষ্কে এখনও ‘আতঙ্ক’। গলিতে গলিতে যেটুকু সম্ভব ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। আয়ও কমেছে তার। স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ৭৬ বছর বয়সী এ বৃদ্ধ।

বরকত বিশ্বাসের ভাষ্য, ‘বড় রাস্তায় যাওনের মতো অবস্থা নাই। পুলিশের গাড়ির হুইসেল শুনলেও ডর লাগে। তার ওপর আবার আর্মিও আসছে। গলিতে বেচা-বিক্রি কম। আগে দিনে ৪৫০-৫০০ টাকা বেচতাম। এখন ১৫০-২০০ টাকাও হয় না।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৮ জুলাই থেকে উত্তপ্ত বাড্ডা। সহিংসতায় হতাহত হয়েছেন অনেকে। কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন রিকশাচালক, দোকানি ও পথচারীরাও। সবমিলিয়ে সম্প্রতি সহিংসতার মধ্যে ভয়াবহ সময় পার করেছে বাড্ডাবাসী।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, প্রায় ৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে বাড্ডা থানা। এখানে বসবাস করেন ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। তাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত। সহিংসতার দিনগুলোতে ঘরে বসে দিন কেটেছে খেটে খাওয়া এসব মানুষের। গত ২৪ জুলাই থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আয়-রোজগার নেই তাদের। ফলে বরকতের মতোই কষ্টে দিন কাটছে নিম্নবিত্ত মানুষের।

আয়-রোজগারে ভাটা, আতঙ্ক কাটছে না বাড্ডাবাসীর

মধ্যবাড্ডা বাজার গলির প্রবেশমুখে প্রতিদিন বিকেলে নিয়মিত ফুটপাতে লুঙ্গি-গামছা বিক্রি করেন গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘ভয়ে ৮-১০ দিন বের হইনি। খুব গোলাগুলি-মারামারি হয়েছে। আজকেই প্রথম ফুটপাতে বসেছি। এখন পর্যন্ত (বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা) এক টাকাও বেচা-বিক্রি হয়নি।’

বাড্ডা এলাকায় আসবাবপত্রের দোকান অনেক বেশি। আসবাবপত্রের দোকানগুলোতেও বিক্রি নেই। মদিনা ফার্নিচারের স্বত্তাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘দুইটা সপ্তাহ ভয়ে-আতঙ্কে পার করছি। রাস্তার পাশে দোকান। কখন, কে আগুন লাগিয়ে দেয়, সেই আতঙ্কে ছিলাম। দোকানটা ঠিক আছে, এটাই আল্লাহর রহমত। বেচা-বিক্রি হওয়া বা না হওয়া নিয়ে চিন্তা করছি না।’

বাড্ডা এলাকার কয়েকটি মার্কেট এখনো বন্ধ। যেগুলো খুলেছে, তাতেও দোকানপাট চালু হয়েছে কম। লুৎফুন টাওয়ারের কাপড়ের দোকানি রমজান বলেন, ‘আজকেই প্রথম খুলছি। জুমার নামাজ পড়ে আসছি। কর্মচারীদের আসতে নিষেধ করেছি। কোনো ক্রেতা নেই। সবার মধ্যে ভয়। কেউ ভয়ে কেনাকাটা করতে আসছে না।’

আরও পড়ুন

এদিকে, সহিংসতার ঘটনায় বাড্ডা এলাকায় বেশ কিছু স্থাপনা ও অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থান মধ্যবাড্ডায় অবস্থিত পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্সের কার্যালয়ের। এ অফিসের প্রধান ফটক ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভেতরে থাকা ১২টি মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেতরে অফিসকক্ষে থাকা কাগজপত্রও পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

মেরুল বাড্ডায় অবস্থিত কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। বর্তমানে ভবনটি সাদা কাপড়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে থাকা নিরাপত্তা প্রহরীর সালাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাউকে ভবনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে মেরামত করা হবে। তারপর কার্যক্রম শুরু হবে।’

আয়-রোজগারে ভাটা, আতঙ্ক কাটছে না বাড্ডাবাসীর

অন্যদিকে বাড্ডা হোসেন মার্কেট এলাকায় ইবনে সিনা হাসপাতালেও ভাঙচুর চালানো হয়। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসা কর্যক্রম শুরু হলেও তা সীমিত পরিসরে চলছে। তাছাড়া আরও কয়েকটি ভবনেও ভাঙচুর চালানো হয়। সেগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত ১৫ জুলাই প্রথম মেরুল বাড্ডা এলাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। ১৬ জুলাইও তারা বিক্ষোভ করেন। এদিন নতুনবাজার এলাকায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে।

১৭ জুলাই সকালে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। একই দিন বসুন্ধরা এলাকায়ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা নতুনবাজার থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়ক দখলে নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ১৮ জুলাই দুপুর থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে বাড্ডা এলাকায় সহিংসতায় রূপ নেয়। সেনা মোতায়েন ও কারফিউ জারির পর গত ২৩ জুলাই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

এএএইচ/এমআরএম/এএসএম

Read Entire Article