এক মহাকাব্যিক সংগ্রামী জীবনের অবসান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম আছে, যেগুলো কেবল ব্যক্তি নয়—একটি সময়, একটি সংগ্রাম, একটি জাতির আশা ও হতাশার প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম। তিনি শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে সময়ের সঙ্গে লড়াই করা এক সংগ্রামী নারী, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় রাজনীতি, প্রতিরোধ ও প্রত্যয়ের মহাকাব্যিক দলিল। আজ যখন তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন প্রায় স্তব্ধ, যখন অসুস্থতা তাঁকে জনসম্মুখ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তখন ইতিহাসের পাতায় তাঁর জীবনের সংগ্রামী অধ্যায় যেন ধীরে ধীরে এক অন্তিম পর্বে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি কোনো মৃত্যুবার্তা নয়—বরং একটি যুগের বিদায়ের নীরব ঘণ্টাধ্বনি।বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেননি প্রস্তুতি নিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক উত্থান কোনো ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিকতা নয়, কোনো দীর্ঘ সংগঠনিক অভিজ্ঞতার ফল নয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে নিহত হওয়ার পর তিনি প্রবেশ করেন এক শূন্যতার ভেতর—যেখানে ব্যক্তিগত শোক ও জাতীয় রাজনীতি একাকার হয়ে যায়। তথ্য বলছে, ১৯৮১ সালে বিএনপি তখন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত; সংসদে দলটির আসন ছিল সীমিত, নেতৃত্ব ছিল বিভক্

এক মহাকাব্যিক সংগ্রামী জীবনের অবসান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম আছে, যেগুলো কেবল ব্যক্তি নয়—একটি সময়, একটি সংগ্রাম, একটি জাতির আশা ও হতাশার প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম। তিনি শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে সময়ের সঙ্গে লড়াই করা এক সংগ্রামী নারী, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় রাজনীতি, প্রতিরোধ ও প্রত্যয়ের মহাকাব্যিক দলিল।

আজ যখন তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন প্রায় স্তব্ধ, যখন অসুস্থতা তাঁকে জনসম্মুখ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তখন ইতিহাসের পাতায় তাঁর জীবনের সংগ্রামী অধ্যায় যেন ধীরে ধীরে এক অন্তিম পর্বে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি কোনো মৃত্যুবার্তা নয়—বরং একটি যুগের বিদায়ের নীরব ঘণ্টাধ্বনি।বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেননি প্রস্তুতি নিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক উত্থান কোনো ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিকতা নয়, কোনো দীর্ঘ সংগঠনিক অভিজ্ঞতার ফল নয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে নিহত হওয়ার পর তিনি প্রবেশ করেন এক শূন্যতার ভেতর—যেখানে ব্যক্তিগত শোক ও জাতীয় রাজনীতি একাকার হয়ে যায়।

তথ্য বলছে, ১৯৮১ সালে বিএনপি তখন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত; সংসদে দলটির আসন ছিল সীমিত, নেতৃত্ব ছিল বিভক্ত। ঠিক সেই সময়েই খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারম্যান করা হয়। অনেক বিশ্লেষক একে দেখেছিলেন ‘প্রতীকী নেতৃত্ব’ হিসেবে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে—এই নারী প্রতীক ছিলেন না, তিনি ছিলেন রূপান্তরের সূচনা।

সেনানীর সহধর্মিণী থেকে রাষ্ট্রনায়ক বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা কোনো প্রস্তুত পরিকল্পনার ফল নয়। তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন নিয়তির টানে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে যেমন শোকাচ্ছন্ন করে তোলে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঠেলে দেয় এক অনিশ্চিত অধ্যায়ে।

একজন গৃহিণী, একজন সেনানীর স্ত্রী—হঠাৎ করেই তাঁকে তুলে আনা হয় একটি বিপর্যস্ত দলের নেতৃত্বে। অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি সাময়িক সমাধান মাত্র। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা লিখেছে। খালেদা জিয়া প্রমাণ করেছেন—নেতৃত্ব জন্মসূত্রে নয়, সংকটেই তার জন্ম।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক

১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন এক অবিচল প্রতিরোধের নাম। কারাবরণ, নির্যাতন, রাজনৈতিক অবরোধ—কোনো কিছুই তাঁকে পিছু হটাতে পারেনি।
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসস্বীকৃত। সেই সময় তিনি কেবল বিএনপির নেত্রী ছিলেন না—তিনি ছিলেন গণতন্ত্রকামী মানুষের আশা ও প্রত্যয়ের প্রতীক।

১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শপথ নেওয়া ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, নারী শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কিছু অগ্রগতি—সবই তাঁর শাসনামলের অংশ। তবে ক্ষমতার রাজনীতি কখনোই নিষ্কলুষ থাকে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনিক সমালোচনার তীর বিদ্ধ করেছে বারবার। কিন্তু এখানেই তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্যিকতা—সমালোচনার পাহাড় ডিঙিয়েও তিনি বারবার ফিরে এসেছেন জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে।

২০০৭ সালের এক-এগারো রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়। সেই সময় বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়, রাজনীতি থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যাঁরা জনগণের রাজনীতি করেন, তাঁদের মুছে ফেলা যায় না।

এই সময় থেকেই তাঁর জীবনে সংগ্রামের ভাষা বদলে যেতে শুরু করে—রাজপথের সংগ্রাম থেকে বন্দিশালার নিঃশব্দ লড়াইয়ে। কারাগার, অসুস্থতা ও নিঃসঙ্গতা তাঁকে দমাতে পাড়েনি।

বরং ২০১৮ সালে কারাবরণ তাঁর জীবনের সবচেয়ে নির্মম অধ্যায়। একজন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অন্যতম মুখে পরিনত হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাঁকে বন্দী করা হয় একটি অসুস্থ শরীর নিয়ে।

কারাগারে কাটানো দিনগুলো তাঁর শারীরিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। আজ তিনি রাজনীতির মঞ্চে নেই, বক্তব্যে নেই, সিদ্ধান্তে নেই—কিন্তু ইতিহাসে তিনি অনুপস্থিত নন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি সংগ্রামী মহাকব্যিক একটি জীবনের অবসান হলো। গোটা জাতি আজ শোকে কাতর। তিনি তাঁর মার্জিত আচরণ দিয়ে করতে পেরেছিলেন মানুষের মন। তাইতো তিনি কোন নিদিষ্ট দলের নয় হতে পেরেছিলেন জাতীর নেতা।

বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবনের এই পরিসমাপ্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়, এটি ত্যাগেরও নাম। তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায় হয়তো সক্রিয় নয়, কিন্তু তা গভীর অর্থবহ।

আজ তাঁর উত্তরাধিকার বহন করছেন তারেক রহমান। কিন্তু খালেদা জিয়ার নামটি থাকবে ভিন্ন উচ্চতায়—তিনি ছিলেন এক যুগের মুখ, একটি লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।

ইতিহাস কখনো তাৎক্ষণিক রায় দেয় না। সময়ই শেষ বিচারক। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের সাফল্য, বিতর্ক ও অর্জন—সবকিছু মিলিয়ে ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে, যিনি পুরুষশাসিত রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন দৃঢ়তায়। তিনি নিখুঁত ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন অনমনীয়। তিনি অজেয় ছিলেন না, কিন্তু পরাজিতও নন।

বেগম খালেদা জিয়ার জীবন একটি অসমাপ্ত মহাকাব্য—যার শেষ অধ্যায় হয়তো ইতিহাস লিখবে আরও পরে। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত—বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে তিনি একটি স্থায়ী নক্ষত্র।

রাজপথে তাঁর কণ্ঠ আজ স্তব্ধ, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর সংগ্রামের শব্দ কখনো নিস্তব্ধ হবে না। ইতিহাস সব সময় উচ্চকণ্ঠে কথা বলে না। কখনো কখনো ইতিহাস নীরবে হাঁটে—ধীর পায়ে, ক্লান্ত শরীরে, তবু দৃঢ় স্মৃতির ভার নিয়ে। বেগম খালেদা জিয়ার আজকের অবস্থান তেমনই এক নীরব ইতিহাস। তিনি নেই রাজপথে, নেই সভামঞ্চে, নেই মাইক্রোফোনের সামনে—কিন্তু তিনি থাকবেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্মৃতির প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি বিতর্কে, প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংকটে।

আজ তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন অবসানে লেখা কোনো মৃত্যুশোক নয়—বরং এটি একটি যুগের বিদায়গাথা, এক মহাকাব্যিক সংগ্রামের নীরব সমাপ্তির বেদনাময় দলিল।

লেখক: উপাচার্য, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow