এক মানবিক বিশ্বনেতৃত্বের সম্ভাবনা

2 hours ago 4

বিশ্ব আজ এক অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ, দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য ও নৈতিক অবক্ষয়ে মানুষের সভ্যতা যেন দিশাহারা। জাতিসংঘ, একসময় যে প্রতিষ্ঠান ছিল মানবতার আশ্রয় ও বৈশ্বিক ঐক্যের প্রতীক, এখন অনেকের কাছে ক্লান্ত ও অকার্যকর এক সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবী নতুন নেতৃত্বের খোঁজে আছে—যিনি শুধু রাজনীতি বোঝেন না, মানুষকেও বোঝেন। সেই সম্ভাব্য মুখ হতে পারেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ড. ইউনূসের জীবনগাঁথা কেবল অর্থনীতি বা উন্নয়নের ইতিহাস নয়, এটি মানুষের মুক্তির গল্প। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য কোনো নিয়তি নয়। সুযোগ পেলে মানুষ নিজেই নিজের জীবনের পথ গড়ে নিতে পারে। তার প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ ধারণা কোটি মানুষের জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছে। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পরও তিনি থেমে যাননি। বরং সমাজ ব্যবসা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ন্যায়ের ভিত্তিতে নতুন এক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছেন, যা আজ বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়।

জাতিসংঘের মহাসচিবের পদটি কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। বর্তমান বিশ্বে সেই নৈতিকতার ঘাটতিই সবচেয়ে প্রকট। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতিসংঘ পেতে পারে এক নতুন দিশা—এক এমন ধারণার দিকে, যেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে। তার “Three Zero World” ভাবনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এবং বাস্তবমুখী।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা ছিল এক মানবিক উদ্যোগের দৃষ্টান্ত। দুর্নীতি, অবিশ্বাস ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙনের মধ্যেও তিনি চেষ্টা করেছেন শান্তিপূর্ণ ও নৈতিক পথ দেখাতে। তার নেতৃত্বে মানুষ দেখেছে দায়িত্ব ও সহমর্মিতার এক নতুন উদাহরণ—যেখানে ক্ষমতার চেয়ে বড় ছিল আস্থা ও ন্যায়বোধ। এই অভিজ্ঞতা তাকে দিয়েছে এক অনন্য বাস্তব শিক্ষা, যা বৈশ্বিক নেতৃত্বে বিরল সম্পদ।

আন্তর্জাতিক পরিসরে তার গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাবও অনস্বীকার্য। বহু রাষ্ট্রনেতা, চিন্তাবিদ ও মানবাধিকারকর্মী তার চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে তার সমাজ ব্যবসা ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির প্রস্তাবনা এরই মধ্যে বহু দেশে নীতিমালায় জায়গা পেয়েছে। তার এই নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা জাতিসংঘের প্রতি মানুষের আস্থা পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এখন জাতিসংঘের ভেতরেও পরিবর্তনের সময় এসেছে। ভেটো সংস্কৃতি, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ও অতিরিক্ত আমলাতন্ত্র সংস্থাটির প্রাণশক্তি দুর্বল করে ফেলেছে। বড় রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষায় ভেটো ব্যবহারের প্রবণতা অনেক সময় মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন সংস্কারের দাবি উঠছে। এমন বাস্তবতায় ড. ইউনূসের মতো নৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন, যিনি প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে মানবিকতা ও ভারসাম্যের পথে ফেরাতে পারেন।

ড. ইউনূসের দর্শনের মূলে রয়েছে এক সহজ বিশ্বাস—মানুষ জন্মগতভাবে সৃষ্টিশীল ও নৈতিক। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষকেও পরিবর্তনের অংশীদার হিসেবে দেখেছেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতিসংঘকে আবারও ‌‘জনগণের জাতিসংঘ’ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে, যেখানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও অধিকারই হবে অগ্রাধিকার।

আজ পৃথিবী নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায়। এমন একজন নেতৃত্ব, যিনি ন্যায়ের সঙ্গে বাস্তবতার, আর মানবতার সঙ্গে নীতির মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই নেতৃত্বের প্রতীক হতে পারেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, পরিবর্তন সম্ভব যদি আমরা মানুষের প্রতি আস্থা রাখি। জাতিসংঘ যদি সত্যিই মানবতার প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, তবে এখনই সময় এমন নেতৃত্বকে স্বাগত জানানোর, যিনি বিশ্বাস করেন—মানুষই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তি।

রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

এমআরএম/জেআইএম

Read Entire Article