নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিলেও তা হতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বদিউল আলম এ অভিযোগ করেন। ‘বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব? পূর্ব এশিয়া থেকে কিছু শিক্ষা এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার ও অন্যান্য কমিশনের প্রতিবেদন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা’ শীর্ষক এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক খুরশীদ আলম।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের ভোট কেন হলো না, এটা আমারও অভিযোগ। এটা এ দেশের অধিকাংশ মানুষের অভিযোগ। আমি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ছিলাম। আমরা প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার প্রস্তাব করেছি। আমাদের জরিপেও দেখা গেছে বেশির ভাগ মানুষ এই নির্বাচন চায়। আপনারা জানেন কেন তা হয় নাই। আমাদের জাতীয় নির্বাচন করতে হবে, এই নির্বাচন করলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাবে- এ ধরনের অভিযোগ। যদিও তা সত্য নয়। শুধু তাই নয়, আমাদের নির্বাচন কমিশনও বাধ সেধেছে। তারা বলেছে, আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করতে চাই না। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কাজ করতে চাই ‘
বদিউল আলম জানান, এ নির্বাচন না হওয়ার পেছনে রাজনীতিবিদদেরও অবশ্য উদ্দেশ্য আছে। কারণ যারাই ক্ষমতায় আসবেন, পরে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবেন। সেখানে অতীতে কী হয়েছে তা জানা। এসব কারণে দুর্ভাগ্যবশত বিষয়টি নিয়ে কথা বলাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কথাগুলো বিরোধীদের উচ্চকণ্ঠের কাছে বিলীন হয়ে গেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ প্রশ্ন করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে কেন স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিল না? আমার কাছে যে জিনিসটা রহস্য মনে হয়- ৫ আগস্টের পর যখন স্থানীয় সরকারের সবাই পালিয়ে গেল; চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর নেই; জন্ম নিবন্ধন, ডেথ সার্টিফিকেটসহ নানা স্থানীয় সেবা দিতে হয়; সব কিছু ভেঙে গেলো, তখন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করে কেন একটা নতুন স্থানীয় সরকার হলো না? বর্তমান কাঠামোর মধ্যেও নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যদের জমিদারি তো থাকতো না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেবা দিতে বাধ্য হতো। কোনো একটা উদাহরণ দাঁড়াতো। পুরাতন রাজনৈতিক দল সেটা চায় না। শুধু ছাত্ররা ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বলছে, আমরা স্থানীয় সংসদ নির্বাচন কেন করবো না আগে?’
মনজুর আহমেদ জানান, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো চায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে। তাদের স্থানীয় জমিদারিটি আবার নতুন করে চালু করতে। বিকেন্দ্রিকরণ করতে রাজনৈতিক অর্থনীতি কোথায়? এ প্রশ্ন তোলা উচিত। বিকেন্দ্রিকরণ করার ইচ্ছাটি কোথায়? বর্তমান সরকার সেটিকে সহযোগিতা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ঐকমত্যের আলোচনায়ও বিষয়গুলো নেই।
আরও পড়ুন
ফেব্রুয়ারিতেই ভোট, কেউ ফাউল করতে নামবেন না: সিইসি
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আরেকটি ফ্যাসিস্ট সরকার তৈরি হতে পারে
ইসলামপন্থি একটি দল ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাচ্ছে: রিজভী
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত বলেন, গ্রামের কোনো স্কুলে বেঞ্চ লাগলে বরাদ্দ হয় কাবিটার টাকা। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন সংসদ সদস্য। এখানেই তো দুর্নীতি হচ্ছে। সবখানেই সংসদ সদস্যের ভূমিকা আছে। এটা বন্ধ করতে হবে। সংসদ সদস্যের কাজ হচ্ছে নীতি নির্ধারণ করা, দেশ পরিচালনা করা।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে আগামী দুই দশকে কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। অথচ দেশের ৪৪ শতাংশ ব্যবসা ঢাকা-চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত। স্থানীয় সরকারের বাজেট জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ। শুধু কেন্দ্রভিত্তিক উন্নয়ন নয়, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও আর্থিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়।
সেমিনারে মূল গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে পিআরআইয়ের পরিচালক আহমেদ আহসান বলেন, ‘বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়ন করতে পারবে কি না এমন প্রশ্ন আছে। আমাদের গবেষণা বলছে, না। বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন টেকশই উন্নয়ন সম্ভব না বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া। স্থানীয় পর্যায়ে দায়বদ্ধতা না থাকলে সাধারণ মানুষের উপকার হবে না।’
শিক্ষার গুণগত মানের সংকট আছে জানিয়ে পিআরআইয়ের পরিচালক বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি শিক্ষার গুণগত মানে। এভাবে আমাদের উন্নয়ন সম্ভব না। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুরবস্থা দেখছি। ডাক্তার নেই, নার্স নেই। সবই একই কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যেসব দেশ বিগত তিন-চার দশকে বেশি উন্নয়ন করেছে, তাদের উন্নয়নের পেছনে বিকেন্দ্রীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’
আহমেদ আহসানের ভাষ্য, মানুষের আকার অনুযায়ী বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীভূত দেশ। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। যে কারণে দ্রুত গতিতে তারা অনেক ধরনের উন্নয়ন করেছে। ঠিকমতো বিকেন্দ্রীকরণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। ধীরে-সুস্থে এগোতে হবে, কিন্তু এগোনো বাঞ্চনীয়।
পিআরআইয়ের পরিচালক বলেন, ‘উন্নয়ন নিয়ে, দেশের মানুষের প্রয়োজন নিয়ে, হঠাৎ করে কর্ম থেকে নারীরা উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। এসব নিয়ে আলোচনা হারিয়ে গেছে। আমরা কিছুটা সাংস্কৃতিক বিষয়, সাংবিধানিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছি।’
এসএম/একিউএফ/জেআইএম