- স্বাবলম্বী হতে ঋণ নিলেও অর্থ ব্যয় হচ্ছে পরিবারে
- ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান টার্গেট থাকে নারী
- প্রতি বছর বাড়ছে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা
- প্রশিক্ষণ দিয়ে ঋণ দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
সিলেট অঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার সংখ্যা। গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে শহরের অলিগলি পর্যন্ত এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম। অন্যান্য সরকারি বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। সবমিলিয়ে সিলেটে ছোট, মাঝারি, বৃহৎ ও অতি বৃহৎ ক্যাটাগরির ঋণগ্রহীতা এখন প্রায় সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি।
এই বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি নারী। ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, ক্ষুদ্র ঋণের ৯৯ শতাংশ গ্রাহকই নারী। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা, গবাদি পশুপালন কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে ঋণ নিয়েছেন।
কিন্তু বাস্তবচিত্র ঠিক তার উল্টো। নারীর সেই স্বপ্নের ঋণের পেছনে রয়েছে সংসারের আর্থিক পিছুটানের শত শত গল্প। আর্থিক সংকট মেটাতে পুরুষই তার পরিবারের নারীদের কাঁধে তুলে দিচ্ছে ঋণের বোঝা। এতে করে চাপা পড়ছে নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন।
অবশ্য নারীর কাঁধে ঋণের বোঝা চাপানোর জন্য কেবল পুরুষই দায়ী নয়। এটা ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এক নতুন অর্থনৈতিক ফাঁদ। কারণ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরেই নারীকে প্রধান ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। কারণ হিসেবে বলা হয়— পুরুষদের তুলনায় নারীরা ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেন।
আরও পড়ুন
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে প্রভিশন ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
এক হাজার টাকার জন্য বৃদ্ধের ঘরের টিন খুলে নিলেন পাওনাদার
চুয়াডাঙ্গায় মরদেহ আটকে সুদের টাকা আদায়
বেসরকারি এনজিও ব্র্যাকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নারীরা পরিবার ও সমাজের চাপে ঋণের কিস্তি দিতে বাধ্য হয়। পুরুষরা অনেক সময় ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আবার কিস্তির টাকা চাইলে মাথার গরম করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলে। কিন্তু নারীরা তা পারে না। নারীরা পুরুষদের বুঝিয়ে কিস্তি পরিশোধ করতে পারে। যে কারণে টার্গেট করেই নারীদের ঋণ প্রদান করা হয়।’
এই মানসিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকেই ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে প্রকৃত অর্থে নারীর স্বাবলম্বিতা নয় বরং নিয়মিত কিস্তি আদায়ের নিশ্চয়তাই হয়ে উঠেছে এনজিওগুলোর প্রধান লক্ষ্য- এমনটা মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম বলেন, প্রকৃতপক্ষে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ঋণ নেওয়া নারীর সংখ্যা একেবারে কম। বেশিরভাগ নারীই পরিবারের আর্থিক সংকট মেটাতে ঋণ নেয়। যার কারণে পরে কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, শহরের বাসা-বাড়িতে যারা কাজ করেন, তারা অধিকাংশই ঋণগ্রস্ত। তারা কেউই উদ্যোক্তা বা নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ঋণ নেননি। সবাই পরিবারের আর্থিক সংকটে পড়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন।
অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিচ্ছে তাদের বেশিরভাগই ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে না। যার কারণে ঋণ নিয়ে নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার পরিসংখ্যানের চেয়ে দেউলিয়া হওয়ার সংখ্যা বেশি। নারীর ক্ষমতায়নে তাকে স্বাবলম্বী করতে হলে প্রশিক্ষিত করে সঠিক খাতে বিনিয়োগের পথ দেখিয়ে ঋণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তথ্যমতে, সিলেটে ঋণ বিতরণকারী বেসরকারি এনজিওগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে- ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস, এসএসএস, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, উদ্দীপন, পদক্ষেপ, সাজেদা ফাউন্ডেশন, পল্লী মঙ্গল কর্মসূচি।
এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমাজসেবা অধিদপ্তর, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (এসএফডিএফ), প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড, মৎস্য অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ), পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কৃষি, মৎস্য, লাইভস্টক, বনায়ন, কৃষি যন্ত্রপাতি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা ব্যবসা, গৃহায়ন, ক্ষুদ্র পরিবহন, শিক্ষা ঋণ, প্রতিবন্ধী ঋণ, চা শিল্প শ্রমিক ঋণ, চিকিৎসা ঋণ, কারিগরি শিক্ষা ঋণ ও বিদেশ গমন ঋণসহ বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণে করছে।
এমআরএর ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, সিলেটে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে ২৪০টি। এসব শাখার অধীনে সমিতির সদস্য রয়েছেন ৪ লাখ ৬ হাজার ৫৯৫ জন। আর ঋণগ্রহীতা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০ জন। এসব গ্রাহকদের কাছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি রয়েছে এক হাজার ৭০৮ কোটি ১৯ লাখ ৯ হাজার ৯০৫ টাকা।
ক্ষুদ্র ঋণের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক রনজিত কুমার সরকার।
তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে ২০২৪ সালের চেয়ে ২০২৫ সালে ঋণগ্রহীতা আরও বেড়েছে। ঋণের পরিমাণও আরও বেড়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুমোদন হলে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করা হবে।
তিন বছরে ঋণগ্রহীতা ও ঋণের চিত্র
এমআরএর ওয়েবসাইটে বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে- সিলেটে ২০২২ সালে ঋণবিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা ছিল ২১৩টি। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২৮টিতে। আর ২০২৪ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪০টিতে।
এছাড়া ২০২২ সালে সদস্য ছিলে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৭০৫ জন, ২০২৩ সালে ৪ লাখ ১০ হাজার ৯৪৮ জন এবং ২০২৪ সসালে ৪ লাখ ৬ হাজার ৫৯৫ জন।
২০২২ সালে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৯৩ জন, ২০২৩ সালে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৯ জন এবং ২০২৪ সালে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০ জন। ২০২২ সালে ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় এক হাজার একশো কোটি টাকা, ২২-২৩ সালে এক হাজার পাঁচশো কোটি টাকা এবং ২০২৪ প্রায় সালে প্রায় এক হাজার সাতশো কোটি টাকার বেশি।
স্বাবলম্বীও হচ্ছেন নারীরা
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের পাড়িয়াবহর গ্রামের হোসনে আরা বেগম (৪০)। স্বামী আবুল হোসেন পেশায় একজন ট্রাকচালক। তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জননী হোসনে আরা ছিলেন একেবারে অসহায়। পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফান্ডেশনের (পিডিবিএফ) বিয়ানীবাজার শাখা থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। এই টাকার মধ্যে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেন। বাকি টাকা দিয়ে মেয়ের পায়ের চিকিৎসা করান। পরবর্তীতে একটি গরু থেকে ১২টি গরুর মালিক হন হোসনে আরা। বর্তমানে কয়েকটি গরু বিক্রি করে ও সঞ্চয়েরে টাকা দিয়ে পাকা ঘরও তৈরি করছেন তিনি। তিন মেয়ের পড়াশুনার খরচও চলছে তার উপার্জন করা টাকায়।
হোসনে আরা বলেন, ‘আমি প্রথমে ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করি। সময় মতো কিস্তি পরিশোধ করায় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। একে একে ৬ বার ঋণ গ্রহণ করেছি। বর্তমানে আমার নেতৃত্বে একটি সমিতি রয়েছে। এখানে আরও ১৬ জন সদস্য রয়েছেন। ঋণ নিয়ে সবাই কমবেশি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন।’
সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ এলাকর মনিপুরি পাড়ায় ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন বোর্ডেরও একটি সমিতি রয়েছে। এই সমিতির সদস্য ও সভানেত্রী আনিবা দেবী। ২০০২ সালে তিনি হস্তশিল্পের ক্ষুদ্র ব্যবস্যা শুরু করেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে বারাবরই হোচট খাচ্ছিলেন। পরে পল্লী উন্নয়ন বোর্ড থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় সফলতা অর্জন করেন তিনি। বর্তমানে তার তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে ১৫ জন মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি করেছেন তিনি। তার এই সফলতা দেখে মনিপুরি পাড়ার অনেক নারী পল্লী উন্নয়ন বোর্ড থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। অনেকে ঋণ নিয়ে সেলাই মেশিন ক্রয় করে এখন ঘরে বসেই আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন।
জাগো নিউজকে আনিবা দেবী বলেন, সহজ প্রক্রিয়ায় ঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিসর বড় করতে থাকি। এক পর্যায়ে আলোর মুখ দেখতে থাকি। পরে দুই দফায় এই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করেছি।
পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফান্ডেশনের (পিডিবিএফ) বিয়ানীবাজারের কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে অনেকেই ঋণ নেন। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে অনেকেই এখন স্বাবলম্বী।’
তিনি বলেন, ‘একজন সফলতার মুখ দেখলে, আরেকজন ঋণ নিতে এগিয়ে আসেন। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সমিতির সদস্য সবসময় বাড়ছে। যারা সমিতির সদস্য, তারা সহজে ঋণ পেয়ে যান। আর যারা নতুন সদস্য হন তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে কিছুটা সময় লাগে। তাদেরকে নিয়ে হাঁস-মুরগি-পশুপালন নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সমিতির মাধ্যমে তাদেরকে ঋণ দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপপরিচালক মরিয়ম দিলসাদ মনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্পে (৩য় পর্যায়) ৩ হাজার ১৮৫ জন গ্রাহক রয়েছেন। তাদের মধ্যে নারী ২ হাজার ৬৭২ জন এবং পুরুষ ৫১৩ জন। এই প্রকল্প থেকে যারা ঋণ গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে স্বাবলম্বীর হার ৮২ শতাংশ।’
এফএ/জিকেএস