বগুড়ার কাহালু উপজেলার ডোমনপুকুর গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় হাঁটলে চোখে পড়ে পাতাবহুল গাছের ছায়া। নাকে আসে তুলসি, বাসক আর ঘৃতকুমারির তীব্র গন্ধ। স্থানীয়রা জানান, রাস্তার দুপাশের ছোট-বড় সব গাছ লাগিয়েছেন ‘কাদের ভাই’। সর্দি হলে তারা কাদের ভাইয়ের দেওয়া পাতার রস খান। শহরে যাওয়া লাগে না।
কাদের ভাইয়ের পুরো নাম আব্দুল কাদের। তবে গ্রামের সবাই তাকে চেনেন ‘গাছপাগল কাদের’ হিসেবে। বয়স ৭৭ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার গতি, উদ্যম, আর সেবা করার ইচ্ছা এখনো কিশোরের মতো। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি একাই গড়ে তুলেছেন এক নির্জন ভেষজ সাম্রাজ্য।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে গাছ লাগানো শুরু করেন আব্দুল কাদের। তারপর আর থামেননি। সারাজীবন গাছের পেছনে ছুটেছেন। গাছ মানেই ফুল বা ফল নয়, তার কাছে গাছ মানে ওষুধ। প্রতিটি গাছের পাতা, ছাল, মূল সবকিছুর মধ্যেই তিনি খুঁজে পান জীবন বাঁচানোর উপকরণ। কাহালু বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় তিন-চার কিলোমিটারজুড়ে যত গাছ দেখা যায় তার বেশিরভাগই লাগিয়েছেন তিনি।
আব্দুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাছের ভাষা বুঝতে শিখেছি। কোন গাছ কোন রোগ সারায়, সেটা মানুষের শরীর দেখেই বুঝে ফেলি। বিনা পয়সায় মানুষকে গাছের রসের ওষুধ দেই। আমার উপকার পায় বলেই হয়তো মানুষ আজও পাশে আছে।’
‘১৯৬৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে গাছ লাগানো শুরু করেন আব্দুল কাদের। তারপর আর থামেননি। সারাজীবন গাছের পেছনে ছুটেছেন। গাছ মানেই ফুল বা ফল নয়, তার কাছে গাছ মানে ওষুধ। প্রতিটি গাছের পাতা, ছাল, মূল সবকিছুর মধ্যেই তিনি খুঁজে পান জীবন বাঁচানোর উপকরণ। কাহালু বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় তিন-চার কিলোমিটারজুড়ে যত গাছ দেখা যায় তার বেশিরভাগই লাগিয়েছেন তিনি।’
আব্দুল কাদের পেশায় একজন পল্লিচিকিৎসক। ইউনানি মেডিকেল কলেজ থেকে শর্ট কোর্স করেছেন। কিন্তু তার প্রধান পরিচয় ‘বৃক্ষপ্রেমী কাদের’ হিসেবে।
- আরও পড়ুন:
ঢাকায় কেউ সবুজায়নের উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করবে ডিএনসিসি
১০ লাখ গাছ লাগিয়ে গ্রিন চট্টগ্রাম গড়বো: মেয়র শাহাদাত
মিরসরাইয়ে কমে যাচ্ছে ডেউয়া ফল
বৃক্ষমেলায় পৌনে ১৫ কোটি টাকার গাছ বিক্রি
হারিয়ে যাচ্ছে দেশি ফল ‘খেজুর’
বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে ডোমনপুকুর গ্রাম। সেখানে থেকে দক্ষিণ দিকে ঢুকে যাওয়া রাস্তা ধরে এগোলেই কাদেরের বাড়ি। রাস্তার দুপাশে সবুজ ক্ষেত, ঝোপঝাড়। অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারির ক্ষেত চোখে পড়ার মতো।
বাড়ির সঙ্গে শিমুল মূলের বাগানটিও কাদেরের ওষুধি গাছ। ছোট অবস্থায় গাছটির গোড়ায় যে মূলা আকৃতির মূল হয়, সেটির রয়েছে ওষুধি গুণ। শারীরিক দুর্বলতা রোধ ও পেট কষায় ভালো কাজ করে এটি।
অনেক গাছই আমাদের চারপাশে নিতান্ত অবহেলায় পড়ে থাকে। তবে তাবিজ-কবজের কাছে ব্যবহৃত রক্ত চন্ডাল, তুরুপ চন্ডাল, বালিক মূল, বিষ-ব্যথা দূরীকরণের হস্তিপলাশ, আমাশয়ের মহৌষধ কিয়ামূল, ভুই কুমড়া, সাদা লজ্জাবতী, লাল লজ্জাবতী, কালো মেঘ, প্রাণ তুলসি, চন্ডাল, বাইত, নিসিন্ধা, আলকুশি, রাই চন্ডাল, হাড় জোড়া প্রভৃতি গাছ রয়েছে কাদেরের সংগ্রহে।
বাড়ির আঙিনা সংলগ্ন স্থানে আরও রয়েছে দুধরাজ, গরু রসুন, গন্ধভাদালি, গুরু চন্ডাল, আকন্দ, অশ্বগন্ধা, তালমূল, ঈশ্বর মূল, রাজকণ্ঠি, পাথরকুচি, ওলটকম্বল, জোয়ানবীর, বন ঢেঁড়শ, মিরচি দানা, পিপরুল, শতমূল, তেজবল, আমরুল, আপাঙ, পাথরসনা, হিমসাগর, নলিকণ্ঠ, বর্মা চন্ডাল, বাসক, স্বর্ণলতা, ডপ তেরেঙ্গা, জগডুমুর প্রভৃতি। তবে কাদেরের বাগানের সবচেয়ে মূল্যবান গাছ ঈশ্বর মূল।
‘তাবিজ-কবজের কাছে ব্যবহৃত রক্ত চন্ডাল, তুরুপ চন্ডাল, বালিক মূল, বিষ-ব্যথা দূরীকরণের হস্তিপলাশ, আমাশয়ের মহৌষধ কিয়ামূল, ভুই কুমড়া, সাদা লজ্জাবতী, লাল লজ্জাবতী, কালো মেঘ, প্রাণ তুলসি, চন্ডাল, বাইত, নিসিন্ধা, আলকুশি, রাই চন্ডাল, হাড় জোড়া প্রভৃতি গাছ রয়েছে কাদেরের সংগ্রহে।’
ডোমনপুকুর গ্রামে শুধু তার নিজের জমি নয়; প্রতিবেশীর খালি জায়গা, রাস্তার আইল, স্কুল-কলেজের মাঠ যেখানেই জায়গা পেয়েছেন, সেখানে লাগিয়েছেন গাছ।
এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ গাছ লাগিয়েছেন এই বৃদ্ধ। সবই ভেষজ। কোথাও একটা গাছের প্রজাতি পেলেই সেটাকে সংগ্রহ করে এনে লাগিয়ে দেন। কাহালু হাসপাতাল, কাহালু ডিগ্রি কলেজ, ডোমন প্রাইমারি স্কুল, মালঞ্চা কলেজ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, ফকির উদ্দিন স্কুল, বনানী কৃষি অফিস, ওয়াইএমসিএ, হামদর্দ কলেজ সবখানেই দেখা মিলবে কাদেরের লাগানো ওষুধি বাগান।
- আরও পড়ুন:
গাছের নাম হাজার সন্তানের জননী
যেসব ভুলে বীজ থেকে চারা বের হয় না
চারা গাছ রোপণের পর করণীয়
পর্যাপ্ত গাছ না থাকলে রাস্তা দিয়ে কী হবে?
আব্দুল কাদের বলেন, ‘শারীরিক দুর্বলতা, হজমের সমস্যা, আমাশয়, ব্যথা, কাশি এসব গাছ দিয়েই সারানো যায়। আক্রান্তদের শহরে যাওয়ার দরকার হয় না।’
ডোমনপুকুর গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সারাক্ষণ মানুষকে গাছ ও ওষুধের কথা বলে বেড়ান কাদের ভাই। নিজের খেয়ে মানুষের জন্য বাঁচেন। ওষুধ দিয়ে কোনো দিন পয়সা নেননি।’
বগুড়া শহরের ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মেয়ের সর্দি-কাশি এক সপ্তাহে ভালো হয়েছে কাদের ভাইয়ের গাছের রস খেয়ে। লোকমুখে জানতে পেরে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। এটা ওষুধ না, আশীর্বাদ।’
কাহালু ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মনিরুল বলেন, ‘কলেজের চারপাশে ওনার লাগানো গাছে এখন শিক্ষার্থীরাও আগ্রহ দেখায়। স্কুলের শিশুরা এখন গাছ চেনে। এটা কাদের সাহেবের অবদান।’
কয়েক বছর আগে এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে বাগান করেছিলেন আব্দুল কাদের। কিন্তু কে বা কারা রাতের আঁধারে সেই বাগান পুড়িয়ে দেয়। সব গাছ ধ্বংস হয়ে যায়।
ওই ঘটনা প্রসঙ্গে কাদের বলেন, ‘আমি কাঁদিনি। কারণ ভালো কাজে বাধা থাকবেই। তাই আবার লাগাতে শুরু করি। আমি চাই, মানুষ বুঝুক গাছ কত কিছু দিতে পারে। চাই না টাকা, চাই না সম্মান শুধু চাই সহযোগিতা। যেন এই কাজটা আরও বড় করে করা যায়।’
কাহালু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আব্দুল কাদের একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। গাছ নিয়ে তার ভাবনা এবং পরিশ্রম সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক। আমরা তার কাজ সরকারি পর্যায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ‘গ্রামের অনেকেই চান, কাদেরের বাগান যেন সরকারিভাবে রক্ষা ও প্রসারিত করা হয়। তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হতে পারে স্থানীয় ভেষজ গবেষণা কেন্দ্র।’
এসআর/জেআইএম