কায়ারফিলি উপনির্বাচন: লেবারের ধস, বাম রাজনীতির জাগরণ

2 hours ago 5

ব্রিটেনের ওয়েলস অঞ্চলের কায়ারফিলি সেনেড উপনির্বাচনে (২৩ অক্টোবর ২০২৫) আঞ্চলিক দল প্লেইড কামরির ঐতিহাসিক জয় সাম্প্রতিক ব্রিটিশ রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করছে। এটি কেবল একটি আসন জয় নয়, বরং নৈতিক ও রাজনৈতিক স্তরে এমন এক ঘোষণা—যেখানে বর্ণবাদ, বিভাজন ও ঘৃণানির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে মানবিকতা, সহনশীলতা ও সংহতির জয় হয়েছে।

দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে কায়ারফিলি ছিল লেবার পার্টির অদম্য দুর্গ। ১৯১৮ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ওয়েস্টমিনস্টার বা কার্ডিফ বে—যেখানেই নির্বাচন হোক, লেবার কখনও এই আসন হারায়নি। এমনকি ১৯৩১ সালের মতো জাতীয় বিপর্যয়ের সময়েও, যখন লেবার মাত্র ৪৬টি আসনে সীমাবদ্ধ ছিল, তখনও কায়ারফিলি ছিল তাদের হাতে। অথচ ২০২৫ সালের এই উপনির্বাচনে লেবারের ভোট নেমে এসেছে মাত্র ১১ শতাংশে—তৃতীয় স্থানে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক পরাজয় নয়, বরং দলের আদর্শগত সংকটের প্রতিফলন।

২) লেবার পার্টির পতন হঠাৎ নয়। কেয়ার স্টার্মারের নেতৃত্বে দলটি ধীরে ধীরে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী শ্রমজীবী মানুষের দল হিসেবে অবস্থান হারিয়েছে। কল্যাণরাষ্ট্র, শ্রমিক অধিকার ও মানবিক অভিবাসননীতির প্রশ্নে তারা এখন রক্ষণশীল টোরিদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করছে—কে বেশি “কঠোর” হবে সেই মাপকাঠিতে। ফলত লেবারের প্রথাগত ভোটাররা এখন বিভ্রান্ত ও হতাশ; তারা দলটির ভেতরে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে, ওয়েলসের লেবার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে “nation of sanctuary”—অর্থাৎ আশ্রয়ের জাতি—ধারণাকে সমর্থন করলেও, ওয়েস্টমিনস্টারের লেবার নেতৃত্বের ছায়া থেকে বের হতে পারেনি। তাদের প্রচারাভিযান ছিল মূলত ভীতির রাজনীতি: “অন্য কাউকে ভোট দিলে রিফর্ম ইউকে জিতবে।” কিন্তু কায়ারফিলির মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন—ভয় দেখিয়ে নয়, আশা জাগিয়ে রাজনীতি জয় করা যায়।

৩) এই প্রেক্ষাপটে প্লেইড কামরির উত্থান শুধু ওয়েলস নয়, পুরো ব্রিটেনের বাম রাজনীতির জন্য আশার সঞ্চার করেছে। তারা স্পষ্টভাবে অভিবাসনবিরোধী উন্মত্ততার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং ওয়েলসের “আশ্রয়প্রার্থীর দেশ” মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার করেছে। এই নৈতিক দৃঢ়তা আজকের ব্রিটেনে এক বিরল ঘটনা।

রিফর্ম ইউকে এই নির্বাচনে ৩৬ শতাংশ ভোট পেলেও, প্লেইড তাদের চেয়ে ১১ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। লেবার যেখানে তিনগুণ কম ভোট পেয়েছে, টোরিরা নেমে এসেছে মাত্র ২ শতাংশে—প্রায় বিলুপ্তির পর্যায়ে। এই ফলাফল দেখিয়েছে, দক্ষিণপন্থি জনতাবাদী রাজনীতিকে পরাজিত করা সম্ভব—যদি বিকল্প রাজনীতি মানুষের আশা, সংহতি ও ন্যায়বোধের সঙ্গে যুক্ত হয়।

৪) এই নির্বাচনে প্লেইডের সাফল্যের মূল চালিকাশক্তি ছিল স্থানীয় তৃণমূল আন্দোলন। “স্ট্যান্ড আপ টু রেসিজম”সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ঘরে ঘরে গিয়ে আলোচনা করেছে, মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে—রিফর্ম ইউকের ঘৃণানির্ভর বক্তব্য কেবল শরণার্থীদের নয়, স্থানীয় সমাজকেও বিভক্ত করছে। এই সংলাপভিত্তিক রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত জনমানসে আস্থা তৈরি করেছে।

কায়ারফিলির উপনির্বাচন কেবল এক দলের জয় নয়; এটি দেখিয়েছে, বাম রাজনীতি তখনই টিকে থাকে, যখন তা মানুষের আশার সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্ণবাদ, ঘৃণা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই শুধু নীতিগত নয়, মানবিক অস্তিত্বের প্রশ্নও বটে। প্লেইড কামরি প্রমাণ করেছে—একটি নীতিনিষ্ঠ, তৃণমূলভিত্তিক ও মানবিক আন্দোলন এখনো ব্রিটেনের জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

কায়ারফিলির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—রাজনীতির শক্তি আসে নিচু স্তর থেকে, যেখানে জনগণ নিজেরাই অংশ নেয়। শীর্ষনির্ধারিত স্লোগান বা মিডিয়া কৌশল নয়, বরং প্রতিবেশী-প্রতিবেশীর সংলাপই ঘৃণার রাজনীতিকে পরাজিত করতে পারে। এই অংশগ্রহণনির্ভর রাজনীতি আজ ব্রিটেনজুড়ে বামপন্থার পুনর্গঠনের মডেল হতে পারে।

৫) লেবার পার্টির এই ভরাডুবি স্টার্মারের জন্য গভীর সতর্কবার্তা। করবিন যুগে যেভাবে গণআন্দোলন ও তৃণমূল সক্রিয়তা লেবারের প্রাণশক্তি ছিল, স্টার্মারের প্রতিষ্ঠাপনির্ভর নেতৃত্বে তা বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে লেবার এখন টোরিদের প্রতিরূপে পরিণত হয়েছে—এবং একই পরিণতির দিকেই এগোচ্ছে।

তবে ব্রিটেনের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন কিছু শক্তি জন্ম নিচ্ছে। স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের জাতীয়তাবাদী দলগুলো, গ্রিন পার্টি, এবং জেরেমি করবিন ও জাহরা সুলতানার নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল “ইওর পার্টি”—সবাই মিলে এক “নতুন বিদ্রোহী বামধারা”র ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য ইওর পার্টির প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে শত শত মানুষ যোগ দিচ্ছে—যা ঐতিহ্যগত বাম রাজনীতির নতুন এক অধ্যায় সূচনা করতে পারে।

৬) গত এক দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখায়—ব্রিটেনে জনগণ বারবার প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সেটা করবিনবাদ হোক, ব্রেক্সিট গণভোট বা “গেট ব্রেক্সিট ডান” স্লোগান—সবকিছুর পেছনেই ছিল পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। কায়ারফিলিতে প্লেইড কামরির জয় সেই বিদ্রোহকেই নতুন দিক দিয়েছে—বামপন্থার হাত ধরে, মানবিকতার পথ ধরে।

৭) অতএব, কায়ারফিলির উপনির্বাচন কেবল এক দলের জয় নয়; এটি দেখিয়েছে, বাম রাজনীতি তখনই টিকে থাকে, যখন তা মানুষের আশার সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্ণবাদ, ঘৃণা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই শুধু নীতিগত নয়, মানবিক অস্তিত্বের প্রশ্নও বটে। প্লেইড কামরি প্রমাণ করেছে—একটি নীতিনিষ্ঠ, তৃণমূলভিত্তিক ও মানবিক আন্দোলন এখনো ব্রিটেনের জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

লেবার যেখানে ব্যর্থ, সেখানে এই নতুন মানবিক রাজনীতি দেখিয়ে দিচ্ছে—শেষ পর্যন্ত আশা-জাগানিয়া রাজনীতিই টিকে থাকে।

লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article