বয়স ছিল মাত্র ১৬। দরিদ্র দিনমজুর পরিবারের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছিল কিশোর সিয়াম শুভ। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের ছররা গুলিতে প্রাণ হারাল সিয়াম। এই মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, গোটা সমাজের চোখে পানি এনে দিয়েছে।
গত ১৯ জুলাই বগুড়ার সেউজগাড়ী আমতলা মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে মারা যায় সিয়াম। তার সারা শরীরে ছররা গুলির আঘাতে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন।
সিয়ামের ছোট্ট জীবন সংগ্রাম
সাত বছর আগে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া সিয়াম ছিল শাপলা বেগম ও আশিক উদ্দিন দম্পতির স্নেহের ধন। তাদের নিজের কোনো সন্তান ছিল না, কিন্তু সিয়াম ছিল তাদের কাছে সোনা মানিক।
শাপলা বলেন, পেটের সন্তান না হলেও ও ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে আপন। আমরা ওকে পড়ালেখা করাতে চাইছিলাম কিন্তু সংসারের কষ্ট দেখে ও নিজেই কাজ শুরু করে। ছোট থেকেই বলতো, আম্মু, আমি থাকতে তোমার কোনো কষ্ট হবে না।
ঘটনার দিন
১৯ জুলাই বিকেলে সিয়াম তার নানার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে যায়। সেউজগাড়ী আমতলা মোড়ে বিকেল ৪টা থেকে ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। বিকেল ৫টার পর পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়।
পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ও শর্টগানের গুলি ব্যবহার করে। দৌড়ে পালানোর সময় জলকামানের পানিতে পা পিছলে পড়ে যায় সিয়াম। উঠতে গিয়ে তার সারা শরীরে ছররা গুলি লাগে।
সঙ্গের শিক্ষার্থীরা সিয়ামকে বগুড়া নার্সিং হোমে নেয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সন্ধ্যায় চিকিৎসকরা জানান, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে সিয়ামের মৃত্যু হয়েছে।
মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তি
শাপলা বেগম বলেন, আমার কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান, আমার সোনা মানিককে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ও ছিল আমার সবকিছু। ছোট থেকেই কাজ করে সংসারে সাহায্য করতো। বলতো, ‘আম্মু, তোমার কোনো কষ্ট আমি হতে দিব না।’ সেই ছেলেকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হলো। আমরা কীভাবে এই শোক সইবো?
মৃত্যুর পরও হয়রানি
সিয়ামের মৃত্যুর পর বগুড়া সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয়, আন্দোলনকারীদের ককটেল বিস্ফোরণে সিয়াম আহত হয়ে মারা গেছে। তৎকালীন সরকারদলীয় লোকজন সিয়ামের পরিবারকে মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে হয়রানি শুরু করে।
শাপলা ও আশিকের জন্য এটি ছিল আরেকটি বিপর্যয়। শাপলা বলেন, আমাদের নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হলো। আমরা গরিব মানুষ। এই অপবাদ মাথায় নিয়ে কিভাবে বাঁচি?
পরিবর্তন ও নতুন মামলা
গত ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। সিয়ামের বিরুদ্ধে করা সাজানো মামলাটি খারিজ হয়। শাপলা বেগম তার ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে নতুন মামলা দায়ের করেছেন, যেখানে শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
অসহায় পরিবার
সিয়ামের বাবা-মা এখন শোক আর অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। শাপলা বেগম বলেন, সিয়াম আর ওর বাবা সংসার চালাত। এখন কাজ নাই। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমাদের দিকে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি।
সিয়ামের মতো দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা কেন বারবার অন্যায়ের শিকার হবে? এই প্রশ্ন এখন সবার মনে। সিয়ামের গল্প কেবল একটি মৃত্যুর নয়; এটি বৈষম্য, নির্যাতন এবং এক শোষিত শ্রেণির কষ্টের গল্প।
আজ সিয়াম নেই, কিন্তু তার মৃত্যুর শোক, বিচার দাবি এবং তার পরিবারের কান্না যেন সমাজের প্রতিটি স্তরের বিবেককে জাগিয়ে তোলে।