ক্যারিয়ারের শেষটা নিয়ে এখন আর আফসোস করি না: ইমরুল

4 days ago 6

লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেট এখন ইমরুল কায়েসের কাছে অতীত। বাংলাদেশ দলের হয়ে শেষ টেস্ট খেলেছেন ঠিক ৫ বছর আগে, ২০১৯ সালের ২২ থেকে ২৪ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের বিপক্ষে। এবার সাদা পোশাকে চারদিনের তথা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকেও বিদায় বলে দিয়েছেন। সর্বশেষ ম্যাচ খেললেন খুলনা বিভাগের হয়ে ঢাকা বিভাগের বিপক্ষে।

প্রায় ১১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার আরও লম্বা। বাংলাদেশ দলের এক সময়ের অপরিহার্য ওপেনার ইমরুল কায়েসের ক্যারিয়ার শেষে হিসাব-নিকাশ চলছে, তিনি আসলে কেমন ছিলেন। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষে ইমরুল কায়েস ক্যারিয়ার শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুরই তুলেছেন বরং।

ক্যারিয়ারে অপ্রাপ্তি আছে অনেক। প্রাপ্তিও যে নেই তেমন নয়। আরও কিছুদিন টেস্ট দলের হয়ে খেলার ইচ্ছে ছিল; কিন্তু ক্রমাগত উপেক্ষার শিকার হতে হতে তিনি বুঝে গেছেন, আর হয়তো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে উঠবে না। বয়সও হলো ঢের। প্রায় ৩৮। শরীরে তারুণ্যের জোয়ার নেই আর। ফলে নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে ভেবেই অবসরের ঘোষণা দিলেন।

ক্যারিয়ার শেষে নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে আজ মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে অনেক কথাই বললেন ইমরুল কায়েস। সেগুলোই প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হরো পাঠকদের জন্য...।

ক্যারিয়ার শেষে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

ইমরুল কায়েস: ২০০৬ সালে যখন আমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয়, চিন্তা করিনি যে বাংলাদেশ দলের হয়ে এতগুলো টেস্ট খেলতে পারব। আর সব শেষে এখন যেভাবে বিদায় নিলাম, আমি খুব খুশি যে বাংলাদেশের হয়ে ৩৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলতে পেরেছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।
কারণ, এক টেস্ট হোক পঞ্চাশ টেস্ট বা একশ টেস্ট খেলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাই বড়। প্রায় ১০-১২ বছর দলের সঙ্গে থেকেছি, খেলেছি বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন দেশে। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের ছিল। আমি চেষ্টা করেছি ব্যাটিং করে হোক বা কিপিং করে, দলের প্রয়োজনে অবদান রাখতে। আমার হয়তো আরও ভালো টেস্ট ক্যারিয়ার হতে পারত। তবে যেটা হয়নি সেটা নিয়ে এখন আর আফসোস মনে করি না। যা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্‌।

কোন মুহূর্তের অংশ হতে পেরে ভাগ্যবান মনে হয় (তিন সংস্করণ মিলিয়ে)?

ইমরুল: ২০১১ বিশ্বকাপে আমার মনে আছে, আমরা যখন ইংল্যান্ডকে হারালাম। ম্যাচ শেষে আমরা যখন হোটেলে ফিরছিলাম, ওই রাতটার কথা আমার এখনও মনে পড়ে। আমাদের খেলা শেষ হয়েছিল রাত ১০টায়, হোটেলে ফিরতে বেজেছিল রাত ১টা। মানুষজন যেভাবে অপেক্ষা করছিল, আমাদের তারা যেতে দেবে না, আমাদের সঙ্গে তারা আনন্দ করবে। আপনারা জানেন, আর্মি এসে মানুষগুলোকে সরিয়ে আমাদের যেতে দিয়েছিল। হোটেলের সামনেও অনেক মানুষ ছিল। ওই রাতটা মাঝেমাঝে আমাকে নাড়া দেয়। বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটকে ও আমাদেরকে কতটা ভালোবাসে।

সীমিত ওভার নিয়ে পরিকল্পনা?

ইমরুল:আমি আগেও বলেছি বিপিএল ও ডিপিএল খেলব। এনসিএলেও টি-টোয়েন্টি খেলব। অবশ্যই আমি চেষ্টা করব..., ওয়ানডে যেহেতু এখনও আছে, আমি অবসর নেইনি। সামনে প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলা আছে। আমি চেষ্টা করব ক্রিকেট উপভোগ করতে। বিপিএলেও চেষ্টা করব ভালো পারফর্ম করতে। যেখানেই খেলি না কেন, একজন ব্যাটর হিসেবে যদি রান না করেন, তাহলে আত্মতৃপ্তিটা আসে না। চেষ্টা করব ওই তৃপ্তিটা নিয়ে ভালো ক্রিকেট খেলতে।

ক্যারিয়ারের সেরা ওপেনিং সঙ্গী কে?

ইমরুল: তামিম ইকবাল। অবশ্যই। আমি আর তামিম সবচেয়ে সফল ছিলাম। তার সঙ্গে ব্যাটিং আমি উপভোগ করতাম। আমার শক্তি-দুর্বলতা ওকে জানাতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করিনি। যখন ব্যাটিং করেছি, আমি ওকে বলেছি যে এই সময়টা আমি এখন ভুগছি, এই সময়টা কঠিন মনে হচ্ছে। তামিমও এই জিনিসটা বুঝেছে। এই জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন সঙ্গীর সঙ্গে যদি বোঝাপড়া ভালো না থাকে তাহলে কঠিন হয়। সবাই নিজের মতো খেলতে থাকলে সম্ভব না। বোঝাপড়া থাকলে জুটিটা ভালো হয়।

খুলনায় ৩১২ রানের জুটির স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন

ইমরুল: আমার মনে আছে, ২০১৫ বিশ্বকাপ যখন খেলে আসি, আমি ভালো খেলিনি। আসার পর আমাকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল যে, আমি কেন দলে থাকব। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে খেলার দিন আমাকে কিছু কথা বলেছিল। যে কারণে আমি কিছুটা চাপে ছিলাম খেলাটা নিয়ে।

প্রথম ইনিংসে ফিফটি করেছিলাম। এরপর প্রায় দেড়শ ওভার কিপিংও করেছিলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম ওই গরমের ভেতরে। এরপর আমি আর তামিম যখন শুরু করি, তখন প্রায় হারের কাছে ছিলাম। আমাদের যখন শতরানের জুটি হয়ে যায়, তামিম আমাকে বলছিল, ‘দোস্ত আমি আর তুই পারি টেস্ট ম্যাচটা ড্র করতে। জানি কষ্ট হবে। আরেকটু কষ্ট করলে হয়তো ম্যাচটা ড্রয়ের কাছে নিয়ে যেতে পারব।’ এভাবে খেলতে খেলতে যখন দুইশ হয়ে গেল, আড়াইশ হয়ে গেল, তখন বিশ্বাস চলে আসে যে এই ম্যাচটা আমরা ড্র করব। এভাবে আসলে জুটিটা গড়ে উঠেছিল।

অবসরের ঘোষণা দেওয়ার সংস্কৃতি

ইমরুল: বিসিবিকে ধন্যবাদ। আমি যখন তাদের প্রস্তাবটা দেই, খুবই ইতিবাচকভাবে তারা জিনিসটা নিয়েছে। আমি হয়তো আরও দুই বছর খেলতে পারতাম। আমাকে অনেকে বলেছে, ভাই আপনি আরও দুইটা বছর খেলতে পারতেন; কিন্তু আমার কথা হলো, দুই বছরের পর সে হয়তো বলতে পারে, ভাই আপনি কখন ছাড়বেন। তাই আমার মনে হয়েছে, এই কথাগুলো শোনার চেয়ে, নিজে থেকে আমি বুঝেছি যে আমার এখন চলে যাওয়াটা ভালো। এজন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ সম্মান থাকতে থাকতে নিজ বুঝটা পাওয়া ভালো।

সামনে তো অনেক ক্রিকেটার আছে, তারা খেলবে। আমাদের ক্যারিয়ার শেষ। আমাদের জায়গায় নতুন একটা ছেলে আসবে। তার জন্য লম্বা একটা সুযোগ থাকবে। অনেক কিছু চিন্তা করেই আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

তরুণ কাকে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে?

ইমরুল: তরুণদের মধ্যে আমি এখন পর্যন্ত যে কয়জনের ব্যাটিং দেখলাম, আমার কাছে ভালো লেগেছে অমিত হাসান। সিলেটের হয়ে খেলছে। খুব ভালো ব্যাটার। টেকনিকের দিক থেকে, টেম্পারমেন্ট টেস্ট ক্রিকেটের জন্য পারফেক্ট আমি মনে করি। হয়তো নির্বাচকরা তাকে চিন্তা করবে। সে যদি পারফর্ম করতে থাকে, দলে আসবে অবশ্যই।

আপনার দৃষ্টিতে সেরা কোচ, সেরা অধিনায়ক কে?

ইমরুল: এটা তো কঠিন প্রশ্ন... সেরা কোচ, সেরা ক্যাপ্টেন। সেরা ক্যাপ্টেন... সবার সঙ্গেই খেলেছি, মুশফিক থেকে শুরু করে, আশরাফুল ভাই থেকে শুরু করে, লাস্ট খেললাম মাশরাফি ভাইয়ের সময় পর্যন্ত। সবমিলিয়ে আপনি যদি আমাকে বলেন ভালো অধিনায়কত্ব বাংলাদেশের হয়ে কে করেছে, আমি বলব সাকিব আল হাসান। কারণ ওর সময়ে খেলে আমি আমার ভূমিকাটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করত, কি আমার রোল, কিভাবে খেলতে হবে।

চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আমি আবারও বলছি..., অবশ্যই ও অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ কোচ। কিন্তু টেকিনক্যাল হিসেবে তিনি অনেক ভালো কোচ ছিলেন। হয়তো তার অ্যাটিচিউড অনেক সমস্যা ছিল, অনেকের সঙ্গে হতো না। কিন্তু ব্যাটার হিসেবে আমি উনার কাছ থেকে অনেক শিখেছি। ওদিক থেকে বলব, এ দু’জন আমার কাছে ভালো লেগেছে।

কোন কোচ বোঝেনি আপনাকে?

ইমরুল: বোঝে নাই, এরকম না। আসলে আমি একটু কোচদের থেকে দূরে থাকতাম। এজন্য থাকতাম হয়তো কথা বেশি বলতাম না কোচদের সঙ্গে। এত বেশি কোচ অরিয়েন্টেড হতে চাইতাম না। আমার সবসময় পরিকল্পনা ছিল, আমি ভালো খেলবো, ওর কাছ থেকে পজেটিভ কিছু নেওয়ার থাকলে নেব। এর বাইরে কিছু চিন্তা করতাম না।

অধিনায়কত্ব উপভোগ করেন কেমন?

ইমরুল: উপভোগ করেছি কুমিল্লায় যখন ছিলাম তখন কুমিল্লার অধিনায়কত্ব উপভোগ করেছি। কুমিল্লা বিপিএল টিম হিসেবে একটা পেশাদার দল ছিল। ওদিক থেকে আমাদের পরিকল্পনা, সবকিছু হাই কোয়ালিটি ছিল। ওইদিক থেকে অনেক উপভোগ করেছি। অধিনায়কত্ব তো আমি কুমিল্লার হয়ে করতাম আর প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডানের হয়ে করেছি। উপভোগ করেছি। খারাপ না, ভালোই লাগে।

জাতীয় দলে থিতু হতে না পারায় নির্বাচকদের দায় কতটা?

ইমরুল: এই মুহূর্তে এসে এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। যেটা হয়েছে, আমি মনে করি সেটা আমার কপালে ছিল। আমি বলব না, আমি শতভাগ ঠিক ছিলাম। আমি হয়তো আরও ভালো খেলতে পারতাম। ভালো খেললে হয়তো ধারাবাহিক সুযোগ পেতাম। তবে হ্যাঁ সুযোগগুলো যদি আরেকটু ফ্লেক্সিবল থাকত, তাহলে হয়তো আমার ক্যারিয়ারটা ভিন্ন হতো। আমিও জানতাম না, খেলার পর আমি পরের ম্যাচে থাকব কিনা বা পরের সিরিজে থাকব কিনা। এজন্য একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আর হতাশা নেই। আমি চেয়েছিলাম বাংলাদেশ দলকে আরও সার্ভিস দিতে। আমার পিক টাইমে আমি ভালো খেলছিলাম, চেয়েছিলাম দেশকে আরও কিছু দিতে। যেটা বললাম, হয়তো কপালে ছিল না। ভাগ্যে আমি বিশ্বাস করি।

ক্যারিয়ার শেষে কোনো আক্ষেপ আছে?

ইমরুল: আক্ষেপ একটা আছে... বাংলাদেশের হয়ে আমি, সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, রিয়াদ ভাই অনেক দিন একসঙ্গে খেলেছি। যদি বড় আসর থেকে একটা ট্রফি নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে ভালো লাগত। বাংলাদেশের হয়ে দ্বি-পাক্ষিক ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ট্রফি আনতে পারিনি। আয়ারল্যান্ডে একটা পেয়েছি। তবে এশিয়া কাপ বা নিদাহাস ট্রফির মতো বড় কিছু যদি আনতে পারতাম, তাহলে ক্যারিয়ার শেষে ভালো লাগত।

টেস্ট ছাড়লেন, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি কেন নয়?

ইমরুল: টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে খেলার মতো যে ফিটনেস লাগে, আমি যদি কাজ করতে থাকি, তাহলে হয়তো খেলতে পারব কয়েকটা বছর। কিন্তু চার দিনের ম্যাচ খেলতে যে স্ট্রেংথ, যে মানসিকতা লাগে... আমার মনে হয়েছে, এখন তরুণদের সঙ্গে না পারি, তাহলে নিজের কাছেই খারাপ লাগে।

একটা ছেলে যেভাবে বলের পেছনে দৌড়ায়, আমি তো তার সঙ্গে পারছি না। তাই মনে হয়েছে, আমি সঠিক পথে নাই। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে এক দিনে শেষ হয়ে যাবে। আপনি ফুল এনার্জি দিতে পারবেন। যেটা চার দিনের ম্যাচে কঠিন। ওদিক থেকে আমি চিন্তা করলাম।

আইএইচএস/

Read Entire Article