ক্রোধ নিয়ন্ত্রণকারীদের  আল্লাহ ভালোবাসেন

3 weeks ago 16

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘পুণ্যবান ব্যক্তি তারা  যারা ক্রোধ দমন করার স্থানে  তাদের ক্রোধ দমন করে এবং ক্ষমার উপযোগী ক্ষেত্রে অপরাধ ক্ষমা করে, আর আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪)।

আসলে পুণ্যবান ব্যক্তি তারাই যারা নিজেদের ক্রোধকে দমন করতে পারে। আজকাল আমরা লক্ষ্য করছি তুচ্ছ বিষকে কেন্দ্র করে অনেক বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ক্রোধ দমন ও ক্ষমা এটি অনেক বড় একটি গুণ। যাদের মাঝে ক্ষমার বৈশিষ্ট্য আছে তাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে আল্লাহপাকের কাছে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘এবং এদের প্রতি যখন অন্যায় করা হয় তখন তারা প্রতিশোধ তো নেয়, তবে তারা মনে রাখে অন্যায়ের প্রতিশোধ ততটুকুই যতটুকু সেই অন্যায়টি হয়ে থাকে। কিন্তু (অন্যায়কারীকে) শুধরানোর লক্ষ্যে যে ক্ষমা করে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা আশ শুরা, আয়াত: ৩৯-৪০)।

মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে  রাগ দমন করা। রাগ দমনের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যের দোষ চর্চা থেকে নিজের জবানকে হেফাজত করবে আল্লাহতায়ালা তার দোষ গোপন রাখবেন। যে ব্যক্তি নিজের রাগকে হজম করবে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার আজাব মওকুফ করে দেবেন।

আমরা জানি, ক্ষমা এবং উদারতার সর্বোত্তম আদর্শ ছিলেন আমাদের প্রিয় নবি, শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মহানবির (সা.) পবিত্র হৃদয় ছিল ক্ষমার মহাসাগর। তিনি (সা.) পরস্পরের মাঝে ঝগড়া বিবাদ আর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ভাই ভাই হয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে হিংসা করবে না, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ কর না, পরস্পরে বিদ্বেষ রেখ না, একে অপরের সাথে শত্রুতা পোষণ কর না, মূল্য নির্ধারণ হওয়ার পর চড়া দাম দিয়ে অন্যের সওদা ক্রয় কর না, হে আল্লাহর বান্দারা! পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, সে তার ভাই-এর ওপর জুলুম করে না, তাকে নিগৃহীত করে না এবং তাকে হীন জ্ঞান করে না। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ বক্ষপানে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিন বার বলেন, “আততাকওয়া হা হুন্না” অর্থাৎ তাকওয়া এখানে। কোন ব্যক্তি দুরভিসন্ধি আটবার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইদেরকে হীন জ্ঞান করে। প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, ধন-সম্পদ আর মান সম্মান অপর মুসলমানের জন্য হারাম’  (সহি মুসলিম, কিতাবুল বিররে ওয়াস সিলাহ)।

আল্লাহপাকের প্রকৃত বান্দাদের জন্য সর্বদা এই নির্দেশই রয়েছে, তারা যেন হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম জীবনাদর্শের ওপর আমল করে। আমরা যদি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ অনুসরণ-অনুকরণ করে জীবন পরিচালনা করি তাহলেই আমরা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো।

তাই আমাদেরকে নিজেদের অন্তরে অন্বেষণ করতে হবে আমরা কি ঐ জীবনাদর্শের ওপর আমল করে নিজেদেরকে সার্বিকভাবে তাকওয়া দ্বারা সুসজ্জিত করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি? আমাদের অন্তর-আত্মাও কি আল্লাহতায়ালার ভয়ে আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হয়ে এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহপাকের সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ দয়ার্দ্র আর মঙ্গল সাধনে তৎপর রয়েছি?

আমরা যদি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই সবার জন্য মঙ্গল কামনা করি তাহলে আল্লাহতায়ালাও আমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং আমাদের সব চাহিদা পূরণ করবেন আর পরিবার ও দেশ হবে জান্নাত সদৃশ।

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সাহাবিরা তাকে (সা.) কতই না ভালোবাসতেন এবং তার প্রতিটি কথার ওপর আমল করতেন।  ইসলাম গ্রহণ করার পর সেই সব অন্ধকার যুগের মানুষরা নিজেদের অভ্যন্তরে কত অসাধারণ পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। তারা ক্রোধকে দমন করতেন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপম শিক্ষার আলোকে।

এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস উপস্থাপন করছি: হজরত আবু যার গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তার একটি চৌবাচ্চা থেকে লোকদেরকে খাবার পানি সরবরাহ করা হতো। একবার কোন এক পরিবারের কতিপয় লোক আসল, তাদের মধ্য থেকে একজন বললো, কে আছে যে আবু যারের কাছে যাবে আর তার মাথার চুল মুঠিবদ্ধ করে কৈফিয়ত তলব করবে, তখন তাদের মধ্য থেকে একজন বললো, সে এটা করবে। সেই অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি চৌবাচ্চার কাছে তার নিকট গেল আর আবু যারকে বিরক্তিকর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে শুরু করলো। আবু যার দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসে গেলেন এরপর শুয়ে পড়লেন অতঃপর তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  আমাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, দাঁড়ানো অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কেউ রাগান্বিত হলে বসে যাবে, যদি রাগ প্রশমিত হয়ে যায় তো ভাল, নয় তো শুয়ে পড়বে’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৩, বৈরুত থেকে মুদ্রিত)।

অন্য এক বর্ণনায় বর্ণনাকারী উল্লেখ করেন, ‘আমরা একবার উরুরা বিন মুহাম্মদের কাছে বসা ছিলাম, তার কাছে এক ব্যক্তি আসলো আর তার সাথে এমন সব কথাবার্তা বললো যে, সে রাগান্বিত হয়ে গেল। বর্ণনাকারী বলেন, অত্যন্ত রাগান্বিত হওয়ায় সে উঠে দাঁড়িয়ে গেল আর ওজু করে আমাদের কাছে ফেরত আসলো এরপর সে বললো, আমার বাবা, আমার দাদা আতিয়া, যিনি একজন সাহাবি ছিলেন, তার উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রাগ-ক্ষোভ শয়তান থেকে আসে, আর শয়তানকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে আর আগুন নিভানো হয় পানি দিয়ে। অতএব তোমাদের মধ্যে কারো রাগ হলে তার ওজু করে নেয়া উচিত’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২২৬, বৈরুতে মুদ্রিত)।

বিশ্বনবি  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ নিয়ন্ত্রণ করাকে প্রকৃত বীরত্ব বলে আখ্যা দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন একদা হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তিকে তোমরা বড় বীর মনে করো? সাহাবিগণ বলেন, যাকে কেউ যুদ্ধে হারাতে পারে না। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না, বরং প্রকৃত বীর হলো সেই ব্যক্তি যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে’ (আবু দাউদ)।

এই ছিল মহানবি ও বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম বৈশিষ্ট্য।

মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে  রাগ দমন করা। রাগ দমনের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যের দোষ চর্চা থেকে নিজের জবানকে হেফাজত করবে আল্লাহতায়ালা তার দোষ গোপন রাখবেন। যে ব্যক্তি নিজের রাগকে হজম করবে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার আজাব মওকুফ করে দেবেন। কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ওজর পেশ করলে, আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করবেন (তাকে মাফ করে দেবেন)। (বায়হাকি, শুয়াবুল ইমান)

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় এই দোয়া যাচনা করতেন, ‘হে আমার আল্লাহ! আমি অনৈতিক কর্ম, মন্দ কার্যকলাপ আর দুষ্ট আকাঙ্ক্ষা থেকে তোমার আশ্রয় যাচনা করি’ (তিরমিজি)।

আল্লাহপাক আমাদেরকে রাগ দমন করে সবার সাথে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।

[email protected]

এইচআর/জিকেএস

Read Entire Article