>> বন্ধ হয়েছে হাতে চালানো তাঁতশিল্প
>> সুনসান নীরবতা আশ্রমজুড়ে
>> জীবনমান উন্নয়নে নানা প্রকল্প চালুর দাবি
ফেনীর ফুলগাজীতে স্থাপিত ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রমটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের আওতাধীন এ প্রতিষ্ঠানে একসময়ে সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নানামুখী কার্যক্রম ছিল। এখন শুধু স্বল্প পরিসরে ক্ষুদ্রঋণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়েছে হাতে চালানো তাঁতশিল্প। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর হাতে ১০৬ শতক ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জনবহুল আশ্রমটিতে এখন সুনসান নীরবতা। আগের কার্যক্রমগুলো চালুর মাধ্যমে স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নে ট্রাস্ট অথবা সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে এলাকাবাসী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী ফেনীর ফুলগাজীতে আসেন। ৯৫ শতাংশ ভূমির ওপর তিনি ৩১ আগস্ট স্থানীয় বীরচন্দ্র বাজারে (নতুন মুন্সির হাট) খাদি হস্তশিল্প চালু করেন। এলাকার মানুষকে সচেতন ও সেবামুখী করতে হরেক রকমের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের কারণে বীরচন্দ্র বাজারটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। তৎকালীন হস্তচালিত তাঁত চরকার মাধ্যমে উৎপাদিত ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি জনপদের মানুষের চাহিদা পূরণ করতো। পরে তাঁতশিল্পকে ঘিরেই এলাকায় তাঁতিদের বসবাস শুরু হয়।
১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় সচল হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র। যুদ্ধের পর বেশ কিছু তাঁতি জীবিকার তাগিদে চলে যান কলকাতায়। পরে দেশ বিভাজনের পর যেসব তাঁতি ফুলগাজীতে থেকে যান; তারাই আবার শিল্পটিকে নতুন করে সচল করার চেষ্টা করেন। নোয়াখালী জেলার গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট প্রধান কার্যালয় থেকে সহযোগিতা নিয়ে আবারও চালু করা হয় হস্তচালিত তাঁতশিল্পটি।
২০১৩ সালে ভারতীয় উপ-রাষ্ট্রদূত সন্দীপ চক্রবর্তী আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এখানে ৮টি তাঁতযন্ত্রের মাধ্যমে আবার চালু করেন শিল্পটি। বেশ কয়েক বছর এই তাঁতযন্ত্রে স্থানীয় তাঁতিরা কাপড় তৈরি করে চাহিদা মেটাতেন। বর্তমানে অটো পাওয়ার মেশিনে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় কাঁচামাল সুতা ও রং দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে প্রাচীন তাঁতশিল্পটি। ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় তাঁতযন্ত্র ও চরকাগুলো অকেজো হয়ে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। পরিত্যক্ত হওয়ায় এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে।
সরেজমিনে জানা যায়, পাকা রাস্তার পাশে ট্রাস্টের টিনশেডের জরাজীর্ণ সুদীর্ঘ ঘরের এক কোণে ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন ২ নারী ও ২ পুুরুষ। পূর্বপাশে হরেক রকম ফুল-ফল ও বাহারি কাঠের বাগান অতিক্রম করে দেখা যায় ট্রেনিং ও সভা ভবনটি অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। পূর্বপাশের দালানের ঘরটিতে তাঁতকেন্দ্রের সাইনবোর্ডটি থাকলেও ভেতরে চলছে না তাঁতের যন্ত্র ও চরকাগুলো। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নষ্ট হয়ে পড়েছে হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত থাকায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, একসময়ে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের মাধ্যমে মাদক, বাল্যবিয়ে নিরোধসহ নানা সামাজিক ব্যাধি নিয়ে সভা, সেমিনার, নাটকসহ নানা প্রচারাভিযান চলমান ছিল। আশপাশের এলাকার লোকজন নানা কাজে এ কার্যালয়ে আসতেন। তাঁত মেশিনে কাজ করতে আসতেন অনেকে। কার্যালয়ের আত্মকর্মসংস্থানমূলক কার্যক্রম ও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে মুন্সির হাটসহ আশপাশের অনেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প শুরু করেছিলেন।
স্থানীয় আবদুল আউয়াল জানান, প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সর্বপ্রথম আশপাশের এলাকায় স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন করা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সচেতনতা, স্বনির্ভরতায় গান্ধী আশ্রমের গল্পের শেষ নেই। কিন্তু বর্তমানে এখানে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। এখন আর এ অফিসে মানুষের ভিড় দেখা যায় না। শুধু ঋণ বিতরণ করেই অফিসের কর্মকর্তারা দিন পার করছেন। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যালয়টিতে পূনরায় চাঙা করার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের নতুন মুন্সিরহাট শাখা ব্যবস্থাপক সুবিমল দাস বলেন, ‘‘অহিংসাই পরম ধর্ম’ স্লোগানকে ধারণ করে শত বছর ধরে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বহুমুখী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ট্রাস্টের স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও সামাজিক ব্যাধি নিয়ে করা কার্যক্রম এখনো মানুষকে উজ্জীবিত করে।’
তিনি বলেন, ‘তাঁতশিল্পে যান্ত্রিকীকরণের পর হস্তচালিত কার্যক্রমে তাঁতিদের অনাগ্রহে এটি একপর্যায়ে ঝিমিয়ে পড়ে। পরে বন্ধ হয়ে যায়। বিগত বছর বন্যায় আশ্রম কমপ্লেক্স ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে কয়েকটি চলমান প্রকল্প বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে আমরা ৪ জন অফিসে কর্মরত। এখন ঋণ কার্যক্রম ছাড়া অন্য কোনো প্রকল্প আমাদের হাতে নেই। তবে নতুন প্রকল্পের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আছে।’
ফেনী জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শুকদেব নাথ তপন বলেন, ‘ফেনীর ফুলগাজীতে মহাত্মা গান্ধীর নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি এ জনপদের মানুষের সচেতনতা ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক। প্রতিষ্ঠানটিতে দিন দিন কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টির বিষয়টি দুঃখজনক। ট্রাস্ট অথবা সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় উজ্জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছি। এটি সক্রিয় হলে এলাকার মানুষ সচেতন হবে। মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি পাবে।’
আবদুল্লাহ আল-মামুন/এসইউ/জিকেএস