গণতন্ত্রের বাতিঘর খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বের ইতিহাস

3 hours ago 8

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, যিনি ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ নামে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তার কণ্টকাকীর্ণ রাজনৈতিক অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার মধ্যে যখন সমগ্র জাতি দিশেহারা, তখন আলোর দিশারী হয়ে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ‘We Revolt’ ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবনের পথচলা শুরু হয়। তিনি তার দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে অনিশ্চয়তা ও অমানিশার সময় অতিক্রম করেন।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০মে চক্রান্তকারীদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলে বেগম খালেদা জিয়ার ২১ বছরের দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সময় কোন পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তিনি রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের ১০মে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরপর তার নতুন রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা হয়। শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজ ও আদর্শ বাস্তবায়নের সংকল্প নিয়ে তিনি জিয়া পরিবারের পরিসরকে সম্প্রসারিত করে লক্ষ কোটি মানুষের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সময়ে সামরিক শাসক এরশাদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন অন্যতম নেতৃত্বদানকারী শক্তি। তিনি তার প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় বলেন: ‘শহীদ জিয়ার আদর্শ ও পথ নির্দেশনার সফল বাস্তবায়নই আমার জীবনের উদ্দেশ্য।’ ১৯৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে সাত দল ও পনের দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, পরবর্তীতে তারা আবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে যুক্ত হয়। এই সময় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের মধ্যেও বেগম জিয়া আন্দোলনের মঞ্চে দৃঢ় থাকেন।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের পর বেগম খালেদা জিয়া গণতান্ত্রিক ধারার সরকার গঠনের নেতৃত্ব দেন। তিনি শুধু বিএনপিকে সংগঠিত করেননি, বরং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ সংগঠনে রূপ দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিএনপি বিজয়ী হয় এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। তার শাসনামল উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৯৬ সালে বিএনপি বিরোধী দলে যায় এবং গণতন্ত্র চর্চার স্বার্থে সংসদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়ার বিরোধী দলীয় ভূমিকা, এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলের ব্যর্থতা এই বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা-সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং জরুরি অবস্থা জারি করে। ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন গং কল্পকাহিনীর মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় এবং ৭মার্চ তারেক রহমান, ১৬ এপ্রিল আরাফাত রহমানকে গ্রেপ্তার করে। ৩ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। একই সময় শেখ হাসিনাও গ্রেপ্তার হন। মাইনাস-টু ফর্মুলার নামে পরিচিত এই ষড়যন্ত্রের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল কেবল বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া। প্রবল জনমতের চাপে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।

মুক্তির পর বেগম জিয়া আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেন। জরুরি অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নৈতিকতার পরিচয় দেন। তবে আওয়ামী লীগ তৎকালীন শাসকদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। পরবর্তীতে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার হলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং নানা ষড়যন্ত্রের মুখে পরাজিত হয়।

২০১৪ সালে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। তার আপোষহীন রাজনৈতিক অবস্থান নেতা-কর্মীদের মাঝে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দিব না’ এই শ্লোগান তাদের আবেগ নয়, বাস্তবতারই বহিঃপ্রকাশ।

১/১১ এর সময় সেনা সমর্থিত সরকার যখন খালেদা জিয়াকে দেশ ত্যাগের শর্ত দেয় তার সন্তানদের মুক্তির বিনিময়ে, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘এ দেশ ছাড়া আমার কোন ঠিকানা নেই। বাঁচতে হলে এদেশেই বাঁচব এবং মরতে হলে এদেশেই মরব।’ এই প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করে তিনি নেতা-কর্মীদেরকেও নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। তার দুই সন্তান শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন, একজন মৃত্যুবরণ করেন, অন্যজন আজও প্রবাসে চিকিৎসাধীন। এই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার মধ্যেও তিনি জনতার নেত্রী হিসেবে নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।

জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, ৭ নভেম্বরের বিপ্লব, বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার ত্যাগ, সংগ্রাম ও নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে এক নতুন বিএনপি গড়ে উঠেছে, যা ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র তাকে মাইনাস করতে চাইলেও পারেনি। কারণ ইতিহাস তাকে নিজের অক্ষরে অমর করে রেখেছে।

বেগম খালেদা জিয়া শুধু বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় নন তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণের মালিকানা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক অবিনাশী প্রতীক। তার নেতৃত্ব আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো গভীর এবং মাটির মতো সহিষ্ণু। বাংলাদেশের বর্তমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক বাস্তবতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুনর্গঠনে তার নেতৃত্ব আজও অপরিহার্য।

লেখক : প্রফেসর মো. নওশের ওয়ান, ইংরেজী বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।

Read Entire Article