দেশের নগর গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। নগর গণপরিবহন কোনোভাবেই নারীবান্ধব নয়। বাসগুলো কাঠামোগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া বর্তমানে দেশে ৫ লাখেরও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন রয়েছে, যার ৭০ শতাংশ সড়কে চলাচল করছে। এসব যানবাহনের মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনের সংখ্যা ৭৫ হাজার। রাজধানী ঢাকায় ১০ হাজারের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলছে। অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য এসব যানবাহন দায়ী।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) বেলা ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় টেকসই পরিবহন কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্ক।
সংবাদ সম্মেলনে নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক পাহাড়ি ভট্টাচার্য নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় সরকারে কাছে ১৯ দফা দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলোতে টেকসই পরিবহন কৌশলসমূহের মধ্যে রয়েছে, গণপরিবহন খাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। যানবাহন চালকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা প্রদান। সড়ক থেকে দ্রুত মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন প্রত্যাহার। আধুনিক নিরাপত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কোম্পানিভিত্তিক আধুনিক বাস সার্ভিস চালু। রাজধানীর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাস সার্ভিস বাধ্যতামূলক করা। শারীরিক প্রতিবন্ধী বান্ধব বাস সার্ভিস চালু ও নীতি কৌশল প্রবর্তন। নারীবান্ধব গণপরিবহন চালু। মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। শহরের ট্রাফিক ও পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং ছোট যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার দাবি জানানো হয়।
এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি সমূহের মধ্যে রয়েছে, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনআরএসসি) পুনর্গঠন। বিআরটিএ, বিআরটিসি, ডিটিসিএ এর ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার। সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং দুর্ঘটনা রোধে সড়ক, রেল ও নৌ-পরিবহন একত্রিত করে অভিন্ন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় গঠন। জাতীয় বাজেটে সড়ক ব্যবহারকারীদের শিক্ষা-সচেতনতা কার্যক্রমের জন্য পৃথক বরাদ্দ। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গঠিত ট্রাস্ট ফান্ডে প্রতি বছর ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
পাহাড়ি ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘ ৫৪ বছরেও টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন না করার কারণে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গড়ে ওঠেনি নিরাপদ জনবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা। দুর্বল ও অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণে দেশে
সড়ক দুর্ঘটনার হার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ নিহত হচ্ছেন, অসংখ্য মানুষ গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হচ্ছেন। এই বিপুল প্রাণহানি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি হাজারো পরিবারের দুর্ভোগ এবং দেশে বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক সংকট ও ক্ষতির প্রতিচ্ছবি।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য প্রতিকারে কোনো সংস্কারে কমিশন গঠন করেনি। সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা পূর্বের
ধারাবাহিকতায় একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, সরকার এখনও যদি সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশন গঠন করে তাহলেও পরিস্থিতি উন্নতির একটি সুযোগ তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে- আধুনিক, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের সামাজিক উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির অন্যতম শর্ত। এ কারণেই আমরা টেকসই পরিবহন কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবি করছি।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের সদস্য সংগঠনসমূহ, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ), বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন), ইভেন্টফুল বাংলাদেশ সোসাইটি, নুসরাত জাহান তমা ফাউন্ডেশন, সেবা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, থটস অ্যান্ড থরো (গবেষণা প্রতিষ্ঠান) এবং সেন্টার ফর ওয়ার্ক অ্যান্ড অক্যুপেশনাল হেলথ সেফটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এনএস/এমআরএম/জিকেএস