কাঠুরে ইমরান শেখের (৪০) স্বপ্ন ছিল দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে বড় মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। সেই স্বপ্নে বাঁধ সাধে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গাছ থেকে নিচে পড়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যায় তার। এর পর থেকে অচল হয়ে পড়েন তিনি। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে পড়েছেন অথই সাগরে।
ইমরানের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরে। নাজিরপুরের সাতকাচিমায় একটি আবাসনে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি।
পরিবার সূত্র জানায়, ২০১১ সালে বিয়ে, তারপর দুই সন্তানের জন্ম। সুখেই দিন কাটছিল ইমরানের। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর ২০১৯ সালে গাছ থেকে নিচে পড়ে যান তিনি। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ইমরানের মেরুদণ্ড ভেঙে যায় এবং স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে যায়। সেদিন থেকেই ইমরানের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এ দুর্ঘটনার পর থেকে চিরতরে অচল হয়ে পড়েন ইমরান। ফলে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে অভাবে দিন কাটছে কাঠুরে ইমরানের। একদিকে স্ত্রী সন্তানদের ভরণপোষণ অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া, এ দুই মিলিয়ে যেন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন তিনি।

জানা যায়, গত ছয় বছর ধরে প্রতিদিন সকালে ভ্যানের ওপর শুয়ে নিজে ভ্যান চালিয়ে রাস্তায় বের হন তিনি। নিজের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মানুষের কাছে চান সাহায্য। যে টাকা পান তা দিয়েই চলে অভাবের সংসার। কোনোদিন ২০০ টাকা আবার কোনোদিন ৩০০, এ দিয়েই কোনোরকমে চলছে সংসার। দুই বেলা খাবার জোগাড় করাই যেখানে কষ্টসাধ্য সেখানে উন্নত চিকিৎসার কথা ভাবানাতেও আনতে পারছেন না ইমরান ও তার পরিবারের সদস্যরা।
আরও পড়ুন:
চিকিৎসা বন্ধ, হুইলচেয়ারে বসেই চলছে শাওনের জীবিকার লড়াই
তরুণ আশিকের দুটি কিডনিই বিকল, সাহায্যের আবেদন
দুই মেয়ের চিকিৎসায় কিডনি বিক্রি চান হতভাগা বাবা
বর্তমানে সন্তানদের লেখাপড়া অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। টাকার অভাবে ঠিকমতো চলছে না লেখাপড়া, অথচ সন্তানদের মানুষ করে তোলাটাই ছিল তার জীবনের সবথেকে বড় স্বপ্ন। পরিপূর্ণভাবে সুস্থ ও সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন ইমরান ও তার স্ত্রী। সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে আবারও সুস্থ হয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন বলে মনে করেন প্রতিবেশীরা।
ইমরান বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে বাড়ির পাশে একটি গাছ পড়ে গেলে আমি সেখানে গাছটি কাটতে যাই। গাছ কাটতে গিয়ে পড়ে আমার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। এতে নাভির থেকে নিচ পর্যন্ত আর কাজ করে না। কোনো শক্তি বা অনুভূতি নেই। এরপর থেকে এভাবে চলছি। প্রস্রাবের জন্য সব সময় ক্যাথেটার লাগানো থাকে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মানুষের সাহায্যের ওপর বেঁচে আছি। মানুষ যদি সহযোগিতা করে তাহলে আমি খাই, না হলে না খেয়ে থাকি। সন্তানদের টাকার অভাবে লেখাপড়া করাতে পারি না। বর্তমান চিকিৎসা করানোর মতো কোনো টাকা নেই। কেউ যদি সহযোগিতা করতো তাহলে উপকার হতো। ছয় বছর ধরে এই ভ্যানের ওপর শুয়ে আছি।
আরও পড়ুন:
শেষ বয়সে খুপরিতে দিন কাটছে প্রবাসীর, পাশে নেই স্ত্রীসহ স্বজনরা
উপার্জনের শেষ সম্বল দুই গরু চুরি হওয়ায় নিঃস্ব বৃদ্ধা জরিনা বেগম
টিউমারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মা-ছেলের জীবন
ইমরানের স্ত্রী মাহিনুর বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর দিনমজুরি কাজে গাছ কাটতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যায় আমার স্বামীর। এরপর থেকেই আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। যদি কোনো সাহায্য পেতাম তাহলে অনেক উপকার হতো। টাকার অভাবে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারি না। বর্তমানে খুব অসহায় অবস্থায় আছি আমরা। যদি কোনো সহযোগিতা পেতাম তাহলে সংসারটা ভালোমতো চলতো।
প্রতিবেশী রুহুল আমিন বলেন, ইমরান ভাই আমাদের বড় ভাই, তিনি দিনমজুরি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। তিনি ব্যাটারিচালিত ভ্যানে চড়ে মানুষের কাছে সহযোগিতা চান। সেখান থেকে যা পান তা দিয়েই চলে সংসার।

রফিকুজ্জামান নামে একজন বলেন, পরিবারটি বর্তমানে অনেক খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। তাদের কাছে এমন কোনো অর্থ নেই যা দ্বারা ইমরানের ভালো চিকিৎসা করানো যায়। গাছ কাটতে গিয়ে তার এই দুর্ঘটনা ঘটে। টাকার অভাবে ঠিকমতো ওষুধ কিনতে পারছে না। এমনকি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াও বন্ধ রয়েছে।
নাজিরপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মাহবুব বলেন, ইমরান শেখ তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। দুর্ঘটনার কারণে কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত বর্তমানে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে তাকে একটি হুইল চেয়ার ও প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়াও ইমরানের ওষুধ কেনার জন্য বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করা হয়। সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা এলে ইমরানকে সহযোগিতা করা হবে।
মো. তরিকুল ইসলাম/এমএন/এএসএম

1 hour ago
3









English (US) ·