দীর্ঘ তিন বছরের টানাপড়েন ও কূটনৈতিক অচলাবস্থার পর ভারত ও চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি ও বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ দুটি কী তবে এবার বৈরিতা পেছনে ফেলে নতুন বন্ধুত্বের পথে হাঁটতে চলেছে- সেই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।
সোমবার (১৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে বৈঠকে বসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। এটি ছিল ওয়াং ইয়ের প্রায় তিন বছর পর প্রথম ভারত সফর।
কূটনৈতিক মহল মনে করছে, এ বৈঠক শুধু সীমান্ত বিরোধ বা আনুষ্ঠানিক কূটনীতি নয়, বরং দুই দেশের দীর্ঘ তিক্ত সম্পর্ক কাটিয়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সফরের অংশ হিসেবে ওয়াং ই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন, যা ভারত-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সীমান্ত ও কূটনৈতিক অচলাবস্থা
২০১৯ সালের পর থেকে ভারত-চীন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষ, গালওয়ান উপত্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে বিরোধের কারণে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যায়। করোনা মহামারির শুরুর পর ভিসা ও ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ও থেমে যায়। ওয়াং ইয়ের বর্তমান সফর সেই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত উচ্চ শুল্ক নীতি শুধু চীন নয়, ভারতের অর্থনীতিতেও বড় চাপ তৈরি করেছে। রপ্তানি ও আমদানি উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এশিয়ার দুই দেশ। বিশ্লেষকদের মতে, এ কারণেই ভারত ও চীন নিজেদের পারস্পরিক দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছে। ওয়াং ই বৈঠকে বলেন, ‘হাতি ও ড্রাগনকে একসঙ্গে নাচানোই সঠিক পথ।’ তার বক্তব্যে স্পষ্ট—অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে ভারত ও চীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অপরিহার্য।
পাকিস্তান ইস্যুতে জটিলতা
যদিও সম্পর্কের পূর্ণ পুনর্গঠনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান। বেইজিং বরাবরই ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। অন্যদিকে দিল্লির কাছে পাকিস্তানই অন্যতম প্রধান নিরাপত্তা হুমকি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাকিস্তান ইস্যুতে কোনো সমাধান না হলে ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতা
তবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। ব্রিকস, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে ভারত ও চীন পরস্পরের সঙ্গে কাজ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সহযোগিতা যদি আরও জোরদার হয়, তবে অর্থনীতি থেকে শুরু করে ভূরাজনীতির ভারসাম্যেও বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
নতুন বন্ধুত্বের সম্ভাবনা
ভারত ও চীন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ দুইয়ে রয়েছে। একইসঙ্গে তারা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। এ দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার হলে শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও বড় প্রভাব পড়বে। তাই ওয়াং ইয়ের এই সফরকে অনেকেই ভারত-চীন সম্পর্কের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘চরম শত্রু’ হিসেবে পরিচিত দুই দেশ যদি আস্থা ও পারস্পরিক স্বার্থে একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে এশিয়ার ভূরাজনীতি নতুন ভারসাম্য পাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সীমান্ত বিরোধ, পাকিস্তান ইস্যু এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না দিল্লি ও বেইজিং। সময়ই দেবে তার উত্তর।