একসময় যোগাযোগ মানেই ছিল চিঠি। অপেক্ষার প্রহর গুনে ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে-মাঠে হইচই পড়ে যেত। দূরে থাকা বাবা, প্রবাসী স্বামী কিংবা প্রিয় বন্ধুর খবর পৌঁছে যেত সাদা কাগজের ভাঁজে। কিন্তু সেই চিঠি খুলে পড়তে হলে দরকার ছিল একটি বিশেষ যোগ্যতা। প্রয়োজন ছিল সাক্ষরতার। অক্ষর না চিনলে চিঠির ভেতরের আনন্দ কিংবা দুঃখ, কোনো কিছুরই নাগাল পাওয়া যেত না।
আজ আর ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। হাতে মোবাইল ফোন, আঙুলের ছোঁয়ায় পৌঁছে যাচ্ছে মেসেজ। কেউ লিখছে না ‘প্রিয়তমা’ দিয়ে শুরু হওয়া দীর্ঘ চিঠি, বরং পাঠিয়ে দিচ্ছে ইমোজি ভরা ভয়েস নোট। চোখ দিয়ে অক্ষর পড়ার চেয়ে কানে শোনা এখন অনেক সহজ। ভয়েস কল কিংবা রেকর্ড পাঠানো আমাদের যোগাযোগকে করেছে দ্রুত। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সাক্ষরতার প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে?
আসলে যোগাযোগ মাধ্যম পাল্টেছে, কিন্তু সাক্ষরতার গুরুত্ব এক বিন্দুও কমেনি। ধরুন, গ্রামে কোনো মা আছেন যিনি পড়তে জানেন না। ছেলে বিদেশে কাজ করে টাকা পাঠিয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। টাকার মেসেজটি ফোনে এলেও তিনি বুঝতে পারছেন না কত টাকা এসেছে। যার অক্ষরজ্ঞান আছে, তার কাছে যেতে হচ্ছে। এই একটুখানি অক্ষরজ্ঞান না থাকার কারণে তার স্বাধীনতা কোথাও গিয়ে আটকে যায়!
অথচ একসময় চিঠির মাধ্যমেই সাক্ষরতার দরকার কতটা বোঝা যেত। কারও কারও জীবনে সেই 'অপঠিত চিঠি' হয়ে থাকত ব্যথার স্মৃতি। আজকের দিনে যদিও ভয়েস কল দিয়ে যেকোনো খবর জানিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ব্যাংকের কাগজপত্র, সন্তানের স্কুলের নোটিশ, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন এসব বোঝার জন্য এখনো অক্ষর চেনার বিকল্প নেই।
প্রযুক্তি যেন একদিকে সাক্ষরতার প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে আবার আরও বাড়িয়েছে। আগে শুধু নাম লিখতে জানলেই চলত, এখন ডিজিটাল দুনিয়ায় টিকে থাকতে পড়ালেখা, এমনকি কিছুটা ইংরেজি জ্ঞানও অপরিহার্য। ফেসবুকের নিউজ ফিড, অনলাইন ফর্ম, চাকরির আবেদন এসব থেকে বঞ্চিত হয় সেইসব মানুষ, যারা এখনো অশিক্ষার অন্ধকারে আটকে আছেন।
তাদের জন্যই প্রতিবছরের ৮ সেপ্টেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ইউনেস্কো স্বীকৃত দিবস এটি। ২৬ অক্টোবর ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪ তম অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়েছিল, এবং ১৯৬৭ সাল থেকে উদযাপিত হয় দিবসটি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও, বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এই দিনে অন্তত সেই সব মানুষকে নিয়ে কাজ করা উচিত, যাদের অক্ষর জ্ঞান নেই। কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা শুধু চাকরি কিংবা ব্যবসার কাজে নয়, মনস্তাত্ত্বিক বিকাশেও সমান গুরুত্ব রাখে।
আমাদের দেশে এখনো হাজার হাজার শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে পথশিশুরা, যাদের জীবন কাটে ফুটপাত বা রেলস্টেশনে। তাদের সকাল শুরু হয় কাজের খোঁজে, স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি নয়। অথচ শিক্ষার আলো পেলে তারাও সমাজের মূলধারায় এগিয়ে যেতে পারত। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তারা রয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার দুষ্টচক্রে।
শুধু শিশুরাই নয়, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও পড়াশোনা না জানার কারণে প্রতিদিন সমস্যায় পড়েন। কেউ ব্যাংকের ফরম পূরণ করতে পারেন না, আবার কেউ বাজারের হিসাব লিখে রাখতে পারেন না। অনেক সময় মোবাইল ফোনে আসা গুরুত্বপূর্ণ মেসেজও পড়তে পারেন না। ফলে তারা সবসময় অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
তাই এই সব প্রতিবন্ধকতা এড়াতে প্রয়োজন স্বাক্ষর জ্ঞান। শিক্ষার হার বাড়াতে সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিনামুল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদান। এছাড়াও বাধ্যতামূলক অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান অন্যতম। তবে শুধু সরকার নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও এনজিও সংস্থাও এ নিয়ে কাজ করছেন।
অক্ষর চেনা শুধু কাগজের চিঠি পড়ার জন্য দরকার নয়, মানুষের স্বাধীনতা, সম্মান আর সক্ষমতার চাবিকাঠিও বটে। আগে যে সাক্ষরতা মানুষকে দিত ভালোবাসার চিঠি পড়ার আনন্দ, আজ সেই সাক্ষরতা দিচ্ছে ডিজিটাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার।
তাই পরিবর্তিত সময়ে সাক্ষরতার সংজ্ঞা হয়তো পাল্টেছে, কিন্তু এর গুরুত্ব একই রকম অটুট। একসময় চিঠির খামে লুকানো থাকত সাক্ষরতার মূল্য, আজ তা লুকিয়ে আছে মোবাইল স্ক্রিনের অক্ষরে। আর এই দুই প্রজন্মের মাঝেই সাক্ষরতা টিকে আছে অতীতের স্মৃতিচারণে আর বর্তমানের বাস্তবতায়।
কেএসকে/জিকেএস