‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে পেটভরে খাইতে পারাই আমাদের ঈদ’

1 day ago 7

দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ সিয়াম সাধনার পর মুসলিমরা মিলিত হবে ঈদগাহে। আর এজন্যই নানা ব্যস্ততা। নতুন জামা কেনা। সেমাই চিনি, শিরনি, পায়েসসহ নানা আয়োজন। মাসব্যাপি কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কখনো দিনে বা কখনো রাতে শপিংমলে হরেকরকম কেনাকাটা করে তারা।

শপিংয়ের সময় মলের বাইরের একটা চিত্র সবসময়ই দেখা যায়। রিকশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন বেশকিছু চালক। কখন বের হবে যাত্রী। যথারীতি কেনাকাটা শেষে মানুষ চেপে বসে রিকশায়। যন্ত্রচালিত রিকশায় কিংবা প্যাডেল মেরে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন চালক। যাত্রী তার বিনোদন বা উৎসব-পার্বণ নিয়ে ব্যস্ত। পাড়াপড়শি, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তাদের কেনাকাটা। কিন্তু চালক স্বাভাবিক জীবনধারণের সংগ্রামে লিপ্ত। তার চাওয়া দুবেলা পেটপুরে খাওয়া।

এই নিম্ন আয়ের রিকশাচালকদের নিয়ে জাগো নিউজের আজকের আয়োজন ‘গরীবের ঈদ’। এ নিয়ে কথা হয় রাজধানীর দুই রিকশাচালকের সঙ্গে। জীবনের কষ্টগুলো তারা ঘামের সঙ্গে ধুরে ফেলে দেন। কান্না এলেও চোখের পানি ঝরে না। তাদের কাছে ঈদ মানেই বাড়তি মনোবেদনা। অন্যের সুখ দেখে কষ্ট পাওয়া। দিনশেষে পরিবারের কাছে অপরাধীর মতো ফেরা। স্ত্রীকে বুঝিয়ে দেওয়া- মানিয়ে নাও। টাকা হলে কিনে দেবো। স্ত্রী কখনো আদরে কখনো শাসনে সন্তানকে নিবৃত রাখেন।

আরও পড়ুন

রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় পঞ্চাশোর্ধ রিকশাচালক আবু তাহের জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবা, আমাদের জীবন চলে না। ঈদ কেমনে করমু? ছেলে-মেয়ে নিয়ে পেটভরে খাইতে পারাই আমাদের ঈদ।’

বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ ও বাজার-সদাই করতেই হিমশিম খান। কাউকেই ঈদের পোশাক কিনে দিতে পারেননি। বরং রিকশার জমা না দিতে দিতে এক হাজার টাকা বাকি হয়ে গেছে। প্রতিদিন যা আয় হয় সংসারের খরচ চালাতেই চলে যায়।

আবু তাহের থাকেন আগারগাঁও ৬০ ফিট কলাপাতা রেস্টুরেন্টের পেছনে। স্ত্রী, তিন মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে বিয়ে করে পৃথক হয়ে গেছে। বাকি একটা ছেলে হাফেজি পড়ে, আরেকজন হাফেজ হয়ে কিতাব পড়ে। মেয়েদের দুজনকে বিয়ে দিয়েছেন। একজন পড়াশোনা করে। প্যাডেল রিকশা চালিয়ে দৈনিক তার উপার্জন হয় চার থেকে পাঁচশো টাকা।

রিকশা চালকদের ঈদ প্রস্তুতি, ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে পেটভরে খাইতে পারাই আমাদের ঈদ’
নিম্ন আয়ের মানুষের ঈদ-ছবি জাগো নিউজ

আবু তাহের জানান, বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ ও বাজার-সদাই করতেই হিমশিম খান। কাউকেই ঈদের পোশাক কিনে দিতে পারেননি। বরং রিকশার জমা না দিতে দিতে এক হাজার টাকা বাকি হয়ে গেছে। প্রতিদিন যা আয় হয় সংসারের খরচ চালাতেই চলে যায়।

তিনি বলেন, ঈদ বলতে আমাদের কিছু নেই। ঈদের দিনেও রিকশা চালাই। কাজ করি, খাই। ছেলেদের পরিচিতজনরা অনেক সময় কাপড় বানিয়ে দেয়। এর বাইরে জরুরি প্রয়োজনে লুঙ্গি-শার্ট কেনে। এই জন্য ঈদ চাঁদ হিসাব করি না।

একই অবস্থা আরেক রিকশাচালক মো. হারুনুর রশীদের। তিনি ছিলেন মূলত কাঠমিস্ত্রি। ভোলার বোরহানুদ্দিনে বাড়ি। তিন তিন বার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ভিটা। পরে চলে এসেছেন ঢাকায়। গেল ২০ বছর ধরে থাকেন শেওড়াপাড়া এলাকায়। প্রথমে ঢাকায় দিনমজুর বা জোগালির (মিস্ত্রির সহকারী) কাজ করতেন। ১০ বছর হয় রিকশা চালান। স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তিন মেয়েই মাদরাসায় পড়ে। তাদের খরচ মাসে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়। বাসা ভাড়া ৫ হাজার। বাজার-সদাই নিয়ে তার জীবনধারণ কঠিন। ঈদের বাজারের কল্পনাও করতে পারেন না।

তিনি বলেন, ঈদের দিনেও রিকশা চালাতে হবে। না হয় খাবো কী? পাঁচ সদস্যের পরিবারে একজনের আয়ে চলতেই কষ্ট হয়। তাদের আবার ঈদ কীসের? তার কাছে ঈদ মানে একটু ভালো খেয়ে বাঁচা।

আমাদের যে পরিস্থিতি আমরা সবাই তো নিজ নিজ স্ট্যাটাস রক্ষায় ব্যস্ত। নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের বাইরে যে এই রিকশাচালকদেরও নিয়ে ভাবা দরকার, এটি কখনো মাথায় আসেনি। আসলেই মনে হচ্ছে, তাদের কথাগুলো শোনা দরকার। পারলে সহযোগিতা দরকার।

বাচ্চারা জ্বালায় কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় মেয়ের বয়স ২২, মেঝটার ১৬ বছর। তারা বুঝে যে বাবা কত কষ্ট করে। খাইয়া না খাইয়া পড়ালেখা করে। ছোটটার ১৪ বছর। ও হয়তো বুঝে না। তারপরও তেমন জ্বালায় না। ওদের মা বুঝায়া রাখে।’

তারা মনে করেন, ঈদের বাজার নিয়ে ছুটে চলা মানুষজন জানেই না রিকশাচালকদের ঈদ কেমন? কারো খোঁজ নেওয়ার কি সময় আছে? কেউ কারো দুঃখ শোনার প্রয়োজনও মনে করে না।

এ নিয়ে কথা হয় ঈদবাজার ফেরত সাদেক নামের একজনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের যে পরিস্থিতি আমরা সবাই তো নিজ নিজ স্ট্যাটাস রক্ষায় ব্যস্ত। নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের বাইরে যে এই রিকশাচালকদেরও নিয়ে ভাবা দরকার, এটি কখনো মাথায় আসেনি। আসলেই মনে হচ্ছে, তাদের কথাগুলো শোনা দরকার। পারলে সহযোগিতা দরকার।

আরেকজন মো. রুবেল জানান, আমরা ১০ টাকা নিয়ে রিকশাচালকদের সঙ্গে ঝগড়া করি। তাদের ব্যবহারও অনেক সময় খারাপ থাকে। সব মিলিয়ে তাদের মানবিক বিষয়টা দেখা হয় না। তবে দেখা দরকার।

এসইউজে/এসএইচএস/জেআইএম

Read Entire Article