বাংলাদেশি লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর ফিরোজের বহুল আলোচিত উপন্যাস চৌরাস্তা এখন পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে অ্যামাজনে। উপন্যাসটির বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হবে আগামি বইমেলায়।
এই উপন্যাস নিছক কল্পকাহিনি নয়; এটি টিকে থাকার লড়াই, আত্মত্যাগ, বিদ্রোহ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার এক নির্মম অথচ হৃদয়স্পর্শী দলিল। লেখক দক্ষ হাতে এক তরুণ প্রবাসীর চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন প্রবাস, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক চৌরাস্তা— যেখানে জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত এক অনিশ্চিত মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়।
দেশত্যাগের পেছনের বেদনাময় প্রেক্ষাপট
গল্প শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবসে। কেন্দ্রীয় চরিত্র রাইয়ান, এক মেধাবী তরুণ, যিনি মালয়েশিয়ার এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন শুধু ‘নিরাপত্তা’র খোঁজে। অথচ তার মেধার গন্তব্য হওয়ার কথা ছিল দেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান বুয়েট।
কিন্তু রাইয়ানের বাবা-মা তাদের চোখে দেখেছেন মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড। সেই ভয়াবহ ঘটনার পর তারা একমাত্র সন্তানকে দেশে রেখে আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারেননি। নিরাপত্তার তাগিদে শুরু হয় রাইয়ানের প্রবাসজীবন— যা পরিণত হয় এক গভীর আত্মঅন্বেষণের যাত্রায়।
প্রবাস, পরিবার ও রাষ্ট্রের টানাপোড়েন, উপন্যাসে উঠে এসেছে বাস্তব জীবনের নিঃশব্দ সংগ্রাম— মায়ের দীর্ঘ রোগভোগ ও চিকিৎসার খরচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জোগাতে পার্ট-টাইম কাজ, ঢাকার দূষিত বাতাসে শ্বাসকষ্টে ভোগা দাদি, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত বাবা এবং ছাত্র রাজনীতির নামে রাষ্ট্রীয় দমননীতি।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে বই হাতে লেখক জাফর ফিরোজ
এসব ঘটনাই ধীরে ধীরে রাইয়ানকে নিয়ে আসে জীবনের এক সংকটময় মোড়ে— The Forked Road, বা ‘চৌরাস্তা’। বিপ্লবের আগুনে জ্বলছে দেশ, উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে সময় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বাংলাদেশ তখন রক্তাক্ত আন্দোলনের দাবানলে জ্বলছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত, দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদের অগ্নিমন্ত্র। রাষ্ট্র ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষকে অন্ধকারে ফেলে রাখে, কারফিউয়ের নামে স্তব্ধ করে দেয় জনতার কণ্ঠস্বর।
এই রুদ্ধ সময়েই রাইয়ান সিদ্ধান্ত নেয় দেশে ফেরার— একদিকে মাতৃভূমির টান, অন্যদিকে মায়ের কণ্ঠে প্রতিবাদের আহ্বান। মায়ের আত্মত্যাগে পরিসমাপ্ত এক মহাকাব্যিক যাত্রা সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মুহূর্ত আসে যখন রাইয়ানের মা আন্দোলনের মিছিলে দাঁড়িয়ে পুলিশের সামনে চিৎকার করে বলেন— ‘তোমাদের কি হৃদয় নেই? তোমরা কি অন্ধ হয়ে গেছ?’
কিন্তু সেই মানবিক আহ্বান রাষ্ট্রীয়গুলোর সামনে টিকতে পারে না। সাদা শাড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে থাকেন রাইয়ানের মা— তার মৃত্যু এক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় নিপীড়িত মায়ের, প্রতিরোধী নারীর, এবং একটি জাতির আত্মত্যাগের। বাস্তবতার নির্মমতা ও সাহিত্যিক গভীরতা, জাফর ফিরোজের লেখনশৈলী সাংবাদিকসুলভ তীক্ষ্ণতা ও কবিতার মিশেলে গড়া। উপন্যাসটির ভাষা প্রতীকী, কাহিনি গঠন দৃঢ়। এখানে আছে এক প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গ, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, প্রবাসের নিঃসঙ্গতা ও মানুষের নীরব প্রতিরোধ।
The Forked Road (চৌরাস্তা) নিছক উপন্যাস নয়— এটি ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের এক জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে বাস্তবতা, বেদনা ও বিদ্রোহ মিলেমিশে তৈরি করেছে এক সাহসী সাহিত্য-নথি। উপন্যাস: The Forked Road (চৌরাস্তা), ইংরেজি সংস্করণ: এখনই পাওয়া যাচ্ছে Amazon-এ বাংলা সংস্করণ: আসছে এবারের বই মেলায়।
এমআরএম