বাংলাদেশ কি ওয়ানডে ক্রিকেটে আবার ২০ বছর পেছনে ফিরে গেল? ৫০ ওভারের ফরম্যাটে আবার কি অবস্থানটা তলানিতে গিয়ে ঠেকলো? জিততে ভুলে হারের বৃত্তে আটকে থাকা বাংলাদেশ কি এখন পুরো ৫০ ওভার খেলতেও ভুলে গেছে? শেষ দুই খেলায় যথাক্রমে ২৮ ওভার ৩ ও ২৭ ওভার ১ বলে অলআউট হওয়ার মধ্য দিয়ে যে কঠিন সত্যই ফুটে উঠেছে। তবে কি আবার সেই দুঃসময়ে পতিত হলো বাংলাদেশ?
ওদিকে সেরা আটে জায়গা না পেলে পরবর্তী ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাছাইপর্ব পার হওয়ার হুমকি! পারফরমেন্সের এখন যে করুণ দশা, এই অবস্থার উত্তরণ না ঘটলে সে বাছাইপর্বের বৈতরণি কি পার হতে পারবে টিম বাংলাদেশ?
ভক্ত ও সমর্থকরা চিন্তিত ও শঙ্কিত। ভাববেন না দল খারাপ খেলছে, তাই আক্ষেপ, অনুশোচনা ও হতাশা থেকে বুঝি অমন চিন্তার উদ্রেক ঘটেছে। আসলে তা নয়। বাস্তবতার নিরীখেই অমন বলা হচ্ছে। অনেক বেশি খারাপ খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। জিততে ভুলে যাওয়াই শুধু নয়, ৫০ ওভারের ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটাররা অলআউট হয়ে যাচ্ছে ২৭-২৮ ওভারে। এত খারাপ নিকট অতীতে তো নয়ই, সাম্প্রতিক সময়ে কখনই খেলেনি। অন্তত পাঁচ-ছয় বছরে এতটা খারাপ সময় আসেনি বাংলাদেশের।
খুব বেশি দূর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। অল্প কিছু দিনের ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যাবে সাম্প্রতিক সময় ওয়ানডেতে কতটা খারাপ কাটছে বাংলাদেশের। একটি ছোট্ট পরিসংখ্যানই বলে দেবে সত্যিই অনেক বাজে সময় কাটাচ্ছে টিম বাংলাদেশ। গতকাল আবুধাবিতে আফগানিস্তানের কাছে শেষ ওয়ানডেতে ২০০ রানে হেরেছে মেহেদি হাসান মিরাজের দল। সেই ম্যাচে টাইগারদের ইনিংস শেষ হয়েছে মাত্র ৯৩ রানে। যা শুধু সাম্প্রতিক সময়ই নয়, সাত বছরের মধ্যে প্রথম।
ইতিহাস জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি মিরপুরে শ্রীলঙ্কার কাছে ৮২ রানে অলআউট হওয়ার পর গত সাত বছরে দেশে ও বিদেশে ওয়ানডেতে আর কোনো ম্যাচে ১০০‘র নিচে অলআউট হয়নি বাংলাদেশ। সেই খেলায় টাইগারদের ইনিংস শেষ হয়েছিল মাত্র ২৪ ওভারে। গতকাল ১৪ অক্টোবর সেই লজ্জাজনক পরিণতিই যেন ঘটেছে মিরাজের দলের। বুধবার রশিদ খান আর শামির ধারালো বোলিংয়ে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয়েছে মাত্র ২৭ ওভার ১ বলে। নিকট অতীত ও সাম্প্রতিক সময়ে তো নয়ই, গত সাত বছরে এত কম রান ও ওভারে ইনিংস শেষ করার রেকর্ডও নেই বাংলাদেশের।
শুধু গতকালের ম্যাচই নয়, তার আগের ম্যাচটিও বাংলাদেশ ১০৯ রানে অলআউট হয়েছিল এবং ইনিংস শেষ হয়েছিল মাত্র ২৮ ওভার ৩ বলে। মানে শেষ দুই ম্যাচে পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করাও সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক সময়তো বটেই গত পাঁচ-ছয় বছরে পরপর দুই খেলায় এত করুণ দশা আর চোখে পড়েনি। আফগান বোলিং বিশেষ করে লেগস্পিনার রশিদ খানের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটারদের খুব অসহায় লেগেছে। দেখে মনে হয়েছে রশিদ খানের লেগ ব্রেক, গুগলি আর ফ্লিপার কীভাবে মোকাবিলা করবেন, তা তাদের কিছুই জানা নেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো একেকজন অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে রশিদ খান ঝুলিতে জমা পড়েছে (৩/৩৮, ৫/১৭ ও ৩/১২) ১১ উইকেট।
আগেই জানা, ওয়ানডেতে এটা ছিল টানা চার সিরিজ পরাজয়। সেই গত বছর মানে ২০২৪ সালের মার্চে দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে শেষ ওয়ানডে সিরিজ (২-১ এ) জিতেছিল বাংলাদেশ। তারপর থেকে ওয়ানডে সিরিজ বিজয় যেন আবার ‘সোনার হরিণ’ হয়ে গেছে। কিছুতেই আর তার নাগাল পাচ্ছে না টিম বাংলাদেশ।
২০২৪ সালের নভেম্বরে এই আফগানিস্তানের কাছে আরব আমিরাতের মাটিতে ২-১ এ সিরিজ পরাজয়। গত বছর ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর এ বছর মানে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কার কাছে শ্রীলঙ্কার মাটিতে ২-১ এবং সবশেষ আফগানদের কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়ে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ টাইগারদের।
যদিও ইতিহাস জানাচ্ছে ১৯৯৯ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই পাকিস্তানকে হারিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সে সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। চার বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে আসে বাংলাদেশ। একটি ম্যাচ বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত হয়। এছাড়া সব খেলায় হার থাকে সঙ্গী। আইসিসির দুই সহযোগী সদস্য কানাডা আর কেনিয়ার কাছেও হারতে হয়।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপে খারাপ খেলার ধাক্কা কাটাতে লেগে যায় বেশ কয়েক বছর। তারপর অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বিশ্বকাপে গিয়ে আবার সাফল্যর পথ খুঁজে পায় বাংলাদেশ। হাবিবুল বাশার সুমনের নেতৃত্বে ওই বিশ্বকাপে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েই আবার জয়ের কেতন ওড়াতে শেখে বাংলাদেশ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে সেই করুণ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে থাকে বাংলাদেশ।
এরপর ধীরে ধীরে পারফরমেন্সে উন্নতি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশ জয়ের পথ খুঁজে পায়। তারপর যতই সময় গড়িয়েছে ততই ওয়ানডেতে পারফরমেন্সের গ্রাফ ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। এর মধ্যে উন্নতি করার সর্বোত্তম ক্ষেত্র হয়ে দেখা দিয়েছিল ২০১১ সালের বিশ্বকাপ। ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথ আয়োজক হয়েও ঘরের মাঠে সে আসরে ইংল্যান্ড ছাড়া কোনো বড় দলের সঙ্গে জেতা সম্ভব হয়নি।
ঘরের মাঠে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে তেমন কিছু করতে না পারলেও ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপে গিয়ে নিজেদের মেলে ধরে মাশরাফির দল। প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় টিম বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে শেষ আটের সে লড়াইয়ে না পারলেও ক্রিকেট অনুরাগীদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পায় মাশরাফির দল।
তারপর কয়েক বছর সে জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। ২০১৬-২০১৭ ‘তে দল হিসেবে বাংলাদেশ বেশ গুছিয়ে নেয়। এবং ওয়ানডের বড় দল না হলেও মোটামুটি মাঝারি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ২০১৭ সালে ৫০ ওভারের ফরম্যাটের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলে বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ প্রথম মাথা উচু করে দাঁড়ায়। ভারতের কাছে সেই সেমির যুদ্ধে হার মানলেও টিম পারফরমেন্স খারাপ হয়নি।
২০১৯ সালেও বাংলাদেশ ভালো খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানকে হারায়। কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকেই ধীরে ধীরে সেই নৈপুণ্যের দ্যুতি কমতে থাকে। দল হিসেবে আগের সেই ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে। শেষ দুই বছর ধরে আসলে ওয়ানডেতে সাফল্যর চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই বেশি।
তা যে বেশি তার প্রমাণ হলো শেষ ১২ ওয়ানডেতে টাইগাররা জিতেছে একটি মাত্র ম্যাচ (২০২৫ সালের ৫ জুলাই কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৬ রানে)। বাকি ১১ খেলায় শুধুই হার সঙ্গী। অবস্থা কতটা খারাপ, এ পরিসংখ্যানই কি যথেষ্ট নয়? কে জানে কবে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটবে?
এআরবি/বিএ/জিকেএস