জীবনানন্দ দাশ বেঁচে আছেন প্রকৃতির মাঝে

3 hours ago 4

হারুন অর রশিদ

১৯৫৪ সালের অক্টোবরে কলকাতার আকাশে যেন এক নিঃশব্দ বিষণ্নতা ভাসছিল। হেমন্তের হালকা রোদে শহরের রাস্তায় ধুলোর সঙ্গে মিশে ছিল এক অন্তহীন ক্লান্তি। এই ক্লান্তিরই অংশ হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক কবি—নির্জনতম কবি—জীবনানন্দ দাশ। যাঁর নামের সঙ্গে ‘আনন্দ’ শব্দটি জুড়ে থাকলেও তাঁর জীবনের প্রতিটি দিন ছিল এক অন্ধকার নিরাশার কুয়াশায় মোড়া।

১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ এক অন্যমনস্ক বিকেল। কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলের রাস্তায় একলা হেঁটে চলেছেন কবি। এই ব্যস্ত, লোকারণ্য শহরের মাঝে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে একা। যিনি তাঁর কবিতায় বাংলার মাঠ, নদী, বন, শস্যের গন্ধ, পাখির ডাককে সাথী করেছিলেন, জাগতিক এই নিঃসঙ্গতায় তাঁর আপনজন ছিল সেইসব নিঃশব্দ সত্তাই।

ধর্মতলা থেকে বালিগঞ্জের দিকে চলেছে চব্বিশ নম্বর রুটের বিওজি ৩০৪ ট্রামটি। রাস্তার ধারের হালকা বাতাসে কবি হেঁটে যাচ্ছিলেন, হাতে দুটি ডাব ছেলে রঞ্জুর জন্য হয়তো। ডায়াবেটিসের কারণে দৃষ্টি দুর্বল, অথচ মন তখনো কোনো অচেনা ছায়ার পিছু ছুটছে। অন্যমনস্কভাবে তিনি পার হচ্ছিলেন রাস্তা। ঠিক তখনই বেজে উঠল ট্রামের ঘণ্টা। অবিরাম, সতর্কবার্তা উচ্চারণ করছিল ড্রাইভার, পথচারীরা চিৎকার করে উঠেছিল। কিন্তু সময়ের যে নিয়তি, তা এড়ানো গেল না।

এক মুহূর্তে ট্রাম এসে পড়ল তাঁর সামনে। ইঞ্জিনের কাউ-ক্যাচারে আটকে পড়লেন কবি। মুহূর্তেই রক্তে ভিজে গেল তাঁর সাদা পোশাক, থেঁতলে গেল হাড়, থমকে গেল শহরের কোলাহল। যে মানুষটি সারাজীবন অবহেলায় বেঁচেছিলেন, মৃত্যুর ক্ষেত্রেও সেই অবহেলাই যেন তাঁকে গ্রাস করল।

হাসপাতালের দিনগুললো এক দীর্ঘ মৃত্যুযাত্রা। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। শরীর তখন যেন ভাঙা বাঁশির মতো—বুকে, পায়ে, চোখে গভীর আঘাত। ২ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হলো তাঁকে। পাশে তখন তিনজন সশস্ত্র পুলিশ পাহারা দিচ্ছেন, পাশের খাটে এক খুনির অস্ত্রোপচার চলছে। সেই ভয়াবহ পরিবেশে তিনি শুয়ে আছেন-অচেতন, অথচ জীবিত।

১৭ অক্টোবর কবি-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য ছুটে এলেন তাঁকে দেখতে। মুখ বিকৃত, চোখ ফুলে আছে, তবুও কবির কণ্ঠে তখন এক অদ্ভুত কোমলতা—‘এখানে ভালো লাগছে না। একটা কমলালেবু খেতে পারব?’ এই একটিমাত্র বাক্য যেন তাঁর মানবিক জীবনের শেষ কবিতা। সঞ্জয় ভট্টাচার্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন—কমলালেবু! যে গল্পটি তিনি কখনও বলেননি, সেই স্মৃতি যেন কবির মনের গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।

কবি তখনও মৃত্যুর সীমানা ছুঁয়ে বেঁচে ছিলেন। বন্ধুবর অজিত ঘোষকে তিনি বলেছিলেন—‘ভেবেছিলাম ট্রামটা জলখাবারের সামনে দাঁড়াবে। আমি পার হয়ে যাব। মরেই যেতাম, কিন্তু কেন যেন বেঁচে উঠলাম।’ এই স্বীকারোক্তিই যেন তাঁর জীবনের শেষ ব্যাখ্যা—এ দুর্ঘটনা আত্মহত্যা নয় বরং ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।

আরও পড়ুন
সৃষ্টিতে বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে
আমিনুল ইসলামের কবিতা: বিষয় ও মানস

২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ পৃথিবীর ঘাস, পাখি, বাতাসের কাছে ফিরে যাওয়া। দিনটা ছিল শুক্রবার। সকাল থেকেই কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ব্ল্যাড ব্যাংক থেকে আনা রক্ত আর কাজে লাগল না। হাসপাতালের জানালা দিয়ে তখন আসছিল নরম রোদ। ঠিক এগারোটা পঁয়ত্রিশে তিনি নিঃশব্দে পারি দিলেন অচেনা কোনো আলোয়, যেখানে ট্রামের শব্দ নেই, শুধুই নিস্তব্ধতা।

পরের দিন সকাল থেকে ত্রিকোণ পার্কের বাড়িতে ভিড় জমলো। বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সবাই এসে দাঁড়ালেন নীরব শ্রদ্ধায়। লাবণ্য দাশ তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন—‘সারাজীবন লেখা-লেখা করেই পাগল হয়ে ছিলে, প্রাণ দিলে শুধু লেখাতেই।’ এই একটি বাক্যে যেন ধরা পড়ল জীবনানন্দের সমগ্র জীবন, তাঁর নিঃসঙ্গ লড়াই, তাঁর সৃষ্টির প্রতি আত্মনিবেদন।

জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকতে যতটা অবহেলিত ছিলেন, মৃত্যুর পর ততটাই শ্রদ্ধিত হয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবিতা যেন নতুন অর্থে জেগে উঠেছে প্রতিটি প্রজন্মে। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলিতে—‘রবীন্দ্রনাথের পর বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশের মতো এমন প্রতিভাবান কবির মৃত্যু ঘটেনি।’

ভাবলে বিস্ময় লাগে—যিনি তাঁর কবিতায় বাংলার মাঠ, নদী, ঘাস, শস্যের গন্ধ, পাখির ডাককে ধরে রেখেছিলেন নিঃশব্দ নিষ্ঠায়। তাঁর নিজের মৃত্যুও যেন হয়ে উঠল তাঁরই কবিতার পঙক্তির মতোন একাকী, মর্মস্পর্শী, অথচ চিরন্তন।

আজও যখন কেউ পড়ে—‘অবশেষে সব কিছু মুছে যাবে,/ কেবল রবে পৃথিবীর ঘাস, পাখি, বাতাস।’ তখন মনে হয়, তিনি কোথাও যাননি। তিনি আছেন প্রতিটি রোদের গন্ধে, প্রতিটি নদীর ঢেউয়ে, প্রতিটি ক্লান্ত বিকেলে। তিনি আছেন সেই রূপসী বাংলায়, যাকে তিনি নিজের কবিতায় চিরদিনের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন।

আজও যখন শরতের হাওয়া বয়ে যায় মাঠের ঘাসে, যখন দুপুরবেলা নরম রোদে পাখি ডাকে একা; তখন মনে হয়—তিনি এখনও কোথাও আছেন। হয়তো হেঁটে যাচ্ছেন ল্যান্সডাউন রোডে, হাতে দুটি ডাব, চোখে কুয়াশা, ঠোঁটে মৃদু গুনগুন—‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন’।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article