২৪- এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তান জনতার এমন শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনও দেখা যায়নি বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী লেখক, গবেষক বদরুদ্দিন উমর।
তিনি গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের কাছে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তিনি এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) তিনি ইন্তেকাল করায় ট্রাইব্যুনালে আর তার সাক্ষ্য দেওয়া হবে না।
খ্যাতিমান এ লেখক তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘আয়না ঘর’ নামে যেসব টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছে-যেটা শেখ মুজিবের আমলেও ছিল না। শেখ মুজিব বিরোধীদের সরাসরি হত্যা করতেন। হাসিনা শুধু হত্যা করতেন না, নির্যাতনও করতেন এবং এতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতেন তিনি।
রোববার (৮ সেপ্টম্বর) তার জবানবন্দির বিস্তারিত তথ্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম।
জবানবন্দিতে বদরুদ্দিন উমর বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল ছাত্ররা। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।
তিনি বলেছেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনও দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি ‘গণঅভ্যুত্থানের দেশ’—১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনাগুলো তার উদাহরণ।
তবে এসব অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল, ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল, ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন, এমন পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি।
জবানবন্দিতে বদরুদ্দিন উমর বলেন, হাসিনার পতনের পরদিনই শেখ মুজিবের মূর্তি ও মুরাল সাধারণ মানুষ ভেঙে ফেলে। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি, তবুও এটি ঘটেছে। এটি প্রকৃতির প্রতিশোধ। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে।
বদরুদ্দীন উমর বলেন, শেখ মুজিব নিজেই একসময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘সিরাজ শিকদার কোথায়?’—যেটা ছিল একটি অমানবিক ব্যঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল ওই বছরেরই আগস্টে, যখন মানুষ বলেছিল—’শেখ মুজিব কোথায়?’ এভাবে ইতিহাসে অনেক সময় ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিশোধের রূপে।
এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই—এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনঃউত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।
জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পুনউত্থান অসম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুসলিম লীগের পতনের মতোই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি হয়েছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
বদরুদ্দীন উমর তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে শেখ হাসিনার গভীর সম্পর্ক ছিল। তার দাবি, ভারতই হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তার পতনের পর তিনি ভারতে পালিয়েছেন এবং সেখানেই অবস্থান করছেন। বদরুদ্দীন উমরের মতে, ভারতে থাকাটা তার জন্য এক ধরনের শাস্তি, যেখানে তিনি জ্বলে-পুড়ে মরবেন।
তিনি আরও বলেন, ভারত সরকার নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে শেখ হাসিনাকে মেরেও ফেলতে পারে। যদি এমনটা ঘটে, তাহলে তারা এমনভাবে বিষয়টি সাজাবে যেন মনে হয় কোনো বাংলাদেশি তাকে হত্যা করেছে এবং এ বিষয়ে একটি সংগঠিত প্রচার চালাবে। উমর মনে করেন, যতদিন শেখ হাসিনা ভারতে থাকবেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো হবে না।
বদরুদ্দীন উমরের জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন কারচুপি করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তিনি রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, যেমন—নির্বাচন কমিশন, পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করেন।
তিনি তার জবানবন্দিতে বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রশাসনকে দুটি প্রধান উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রথমত, তিনি ঘুস, টাকা-পয়সা এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কর্মকর্তাদের বশীভূত করতেন। দ্বিতীয়ত, হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি প্রশাসনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। এই নিয়ন্ত্রণের কারণেই তার দল এমন সব নির্বাচনে জয়ী হতে পেরেছিল, যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের চার-পাঁচটি আসনও পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
উমর জানান, শেখ হাসিনা শুধু নির্বাচনের কারচুপিই করেননি, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন। তিনি বলেন, প্রচুর মানুষকে বিনা কারণে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে। তার আমলে ‘আয়না ঘর’ নামে টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছিল, যা শেখ মুজিবের সময়ও ছিল না। শেখ মুজিব যেখানে বিরোধীদের সরাসরি হত্যা করতেন, সেখানে শেখ হাসিনা নির্যাতন করতেন এবং এতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পেতেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করেছিলেন।
ডিজিএফআই-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে ‘আয়না ঘর’-এর মতো গোপন নির্যাতন সেল চালানো হয়েছে এবং গুমের মতো অপরাধও ঘটানো হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বদরুদ্দীন উমর বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপিকে ধীরে ধীরে পিষ্ট করে রাখা হয়েছে। মিটিং-মিছিলে পুলিশ দিয়ে হামলা করা হয়েছে এবং জনসমাবেশগুলো কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। এভাবেই শেখ হাসিনা বিএনপিসহ সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে অকার্যকর করে ফেলেছেন।
বদরুদ্দীন উমর তার জবানবন্দিতে শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের শাসনশৈলীর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব বেপরোয়া হলেও তার রাজনৈতিক পরিপক্বতা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার তা ছিল না। তিনি ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র মতো কেবল শেখ মুজিবের কন্যা হওয়ার কারণেই ক্ষমতায় এসেছিলেন।
এফএইচ/কেএইচকে/জেআইএম