জুলাই সনদ: ঐক্যসূত্র নাকি বিভাজনের রূপরেখা

1 day ago 12

দীর্ঘ আলোচনা-সমালোচনার একটি অধ্যায় শেষ হলো ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদে ২৪টি দলের স্বাক্ষর সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে এই দালিলিক প্রমাণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্বসহ আমলে এনেছিল শুরুতেই। সেই লক্ষ্যেই সংস্কার কমিশনসমূহ গঠন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়।যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো অভ্যুত্থানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে একটা ঐক্যসূত্র তৈরি করা।যাতে অংশীজনদের স্বর্বস্বীকৃতি-সমর্থন থাকবে। মূল বিষয় ছিলো অভ্যুত্থানের মতোই আরেকটি ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা তৈরি করা,যার মাধ্যমে আগামী বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। সেই সুবাদেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে,তাদের কাছ থেকে সুপারিশ গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী তারা সমন্বিত একটি চুক্তিপত্র তৈরি করে যা জুলাই সনদ নামে আখ্যায়িত।

সবসময়ই বলা হয়েছে,এই সনদ মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যসূত্র তৈরি হবে-যার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ নিশ্চিত হবে। সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যেও তাই বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন,‘সমস্ত জাতি একসঙ্গে হয়ে,সমস্ত রাজনৈতিক নেতা একসঙ্গে হয়ে তাঁরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছেন।এরকম ঘটনা ঘটবে,এরকম কেউ আমরা চিন্তাও করতে পারিনি’। তিনি বক্তৃতার আরেক অংশে বলেছেন,‘ঐক্যের মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং এই ঐক্য যেন বজায় থাকে।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো সবসময়ই ঐক্যের কথা বলেছেন।তারা আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন,রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রের কল্যাণে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে। নিজেদের দলীয় স্বার্থের ঊর্ধে তারা জাতীয় স্বার্থকে স্থান দেবে।জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এমন আশাবাদ পোষণ স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু গত ১৩/১৪ মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এবং সর্বশেষ জুলাই সনদ উপলক্ষ্যে রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্ম এই ঐক্যসূত্র কতটা কার্যকর হবে তা নতুন করে ভাবনার জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে।তাদের মধ্যে ৩৩টি দলকে ডাকা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্বের আলোচনায়। অর্থাৎ এই দলগুলোর বুদ্ধি-পরামর্শ গ্রহণকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যৌক্তিক মনে করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে আরও শ’খানেক দলের দোষ কি? বলা হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরোধিতাকারীদের মতামত প্রদানের সুযোগ নেই। তাইলে ধরে নিতে হবে প্রায় ১শত দল জুলাই অভ্যুত্থানে বিরোধিতা করেছিল? যদি বলা হয় জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা অর্থাৎ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতে নিয়োজিত দলগুলোকেই ডাকা হয়েছে। সেটাও কি হয়েছে? ৫২টি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনপ্রাপ্ত। এই দলগুলোর মধ্যে কি শুধু ১৮টি দলই জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলো? এই ১৮টি দলের বাইরে একমাত্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ।বাকি দলগুলো কি সবাই আওয়ামী লীগের সহযোগী? এমন কিছু দল আছে যারা জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলো নিবন্ধিতও বটে। কিন্তু তারা ডাকই পায়নি ঐকমত্য কমিশনে। একটি দল ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য দরখাস্ত করেও প্রত্যাখাত হয়েছে।

অন্যদিকে মোটামুটি বড় দল জাতীয় পার্টি ৮ আগস্ট এ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানসহ শুরুর দিকে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকেও আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছিল।পরবর্তীকালে তাদের ডাকা হয়নি।

জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কিংবা সমর্থনকারীদের কিছু দল যাদের মূল্যায়ণ করা হয়নি বলে ইতোমধ্যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে,তারা সনদকে কতটা মূল্যায়ণ করবে? এমন প্রশ্ন তো থেকেই যায়।অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পরিবর্তনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটাও কি সবাই মেনে নেবে?কিছু অংশ বাদ দেওয়াটাও কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাদের কাছে? মিমাংসিত বিষয়কে নতুন করে বিতর্কের দিকে ঠেলে দিয়ে জাতীয় ঐক্য চিন্তা করা কতটা আশাব্যঞ্জক তা দেখার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সর্বশেষ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ৩০টি রাজনৈতিক দলকে ডাকা হয়েছে যাদের অধিকাংশই নাম সর্বস্ব। ডাকের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকিগুলোও তেমনি। কিন্তু দলীয় সংখ্যা বিবেচনা করলে বাইরে থাকা দলগুলোর সংখ্যা বিশাল। সবচেয়ে বড় কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী অধিকাংশ তরুণদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শেষ মুহূর্তে এসে জুলাই সনদে সই না করে আমন্ত্রণ বহির্ভুত দলগুলোর কাতারে চলে গেছে কিনা এমন সন্দেহও অমূলক নয়।তর্কের খাতিরে মনে করা যাক এনসিপি সনদে সই করবে। তাইলে স্বাক্ষর না করা কিংবা আমন্ত্রণের বাইরে থাকা দলগুলো অধিক নয়?

প্রশ্ন হচ্ছে-তারা কি জুলাই সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করবে?তারা বলতেই পারে এই সনদ আমাদের নয়।অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বাইরে রাখা হলেও তাদের বৃহৎ সমর্থক গোষ্ঠী কিন্তু প্রকাশ্যেই আছে।অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতি বলে দেয়,একটু সুযোগ পেলে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে তাদের নামেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হবে। এই লুপ্ত শক্তি যদি আমন্ত্রণ বহির্ভূত দলগুলোর সঙ্গে সুর মিলায় তখন রাজনৈতিক পরিবেশ কি শান্ত থাকবে বলে মনে হয়?

স্পষ্টত যেখানে দেখা যাচ্ছে-জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সূত্রে গাঁথা সম্ভব হয়নি। অসংখ্য রাজনৈতিক দল যেখানে এই সনদ সংশ্লিষ্ট হতে চেয়েও হতে পারেনি।তাদের সনদের বাইরে রাখার পর প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য-‘সমস্ত জাতি একসঙ্গে হয়ে,সমস্ত রাজনৈতিক নেতা একসঙ্গে হয়ে তাঁরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছেন।’ এর বাস্তবতা কতটুকু থাকে।জুলাই অভ্যুত্থানে সমর্থনকারীদের একটি অংশই যেখানে অনুপস্থিত সেখানে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা আসে কোথা থেকে। আর সমস্ত জাতিও একত্র হয় কী করে?

এবার আসা যাক বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব সংকট তৈরি হওয়ার বিষয়ে। জুলাই অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে এই সনদ মাধ্যমে।এমন অভিযোগ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যোগ দেওয়া ৬/৭টি দলই মনে করে।মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার প্রয়াসকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদের নেতারা। এই দলগুলোর মধ্যে দলগতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সিপিবি। বাকি দলগুলোর নেতাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।তারা সনদে সই করেননি এবং স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও যোগদান করেনি।তাদের বক্তব্য- ‘সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ৬ষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ এবং ৭ম তফসিলে থাকা ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, তা বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না।’

এরপর জুলাই সনদের এই জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। চূড়ান্ত সনদে বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) সংশোধন করা হবে এবং এ সংশ্লিষ্ট পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল সংবিধানে রাখা হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মূল কথা সেখানে সংযোজিত। সেই জায়গা কিভাবে পরিবর্তন করবে তারা। সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ। ষষ্ঠ তফসিলে আছে ১৯৭১ সালের ‘২৫ মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে’ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা। আর সপ্তম তফসিলে আছে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।

অর্থাৎ জুলাই সনদ অনুসারে সংবিধানে সংস্কার হলে তাতে সংবিধানের তফসিলে ৭ মার্চের ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা থাকবে না। তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের তফসিলে থাকবে।

যারা মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস করেন,যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা এই পরিবর্তনকে সহজে মেনে নেবে? এই মুহূর্তে সিপিবিসহ কয়েকটি দল যেমন বেরিয়ে এসেছে তারা কি চুপ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিবর্তনকে মেনে নেবে? তার মানে হচ্ছে আগামীতে জুলাই সনদকেন্দ্রিক ঐক্যভাবনা যথাযথ রূপ লাভ করবে কিনা সন্দেহ গোড়াতেই তৈরি হয়ে গেছে।

ষষ্ঠ তফসিল বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে জুলাই সনদে। যেখানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু জুলাই সনদ অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যুক্ত থাকবে। ষষ্ঠ তফসিল বাদ দেবে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা আছে বলে। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও কি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অংশ বাদ দিয়ে হবে? ঘোষণাপত্রের ষষ্ঠ প্যারায় আছে- ‘যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’

জুলাই সনদকে সেক্ষেত্রে স্ববিরোধী বললে কি অত্যুক্তি হবে? নাকি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও তারা পরিবর্তন করবেন?

জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কিংবা সমর্থনকারীদের কিছু দল যাদের মূল্যায়ণ করা হয়নি বলে ইতোমধ্যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে,তারা সনদকে কতটা মূল্যায়ণ করবে? এমন প্রশ্ন তো থেকেই যায়।অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পরিবর্তনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটাও কি সবাই মেনে নেবে?কিছু অংশ বাদ দেওয়াটাও কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাদের কাছে? মিমাংসিত বিষয়কে নতুন করে বিতর্কের দিকে ঠেলে দিয়ে জাতীয় ঐক্য চিন্তা করা কতটা আশাব্যঞ্জক তা দেখার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article