বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ এক নতুন শব্দবন্ধ—যার ভেতর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রের কাঠামো বদলে ফেলার একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা। দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে তৈরি এই সনদে ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু যতবড় আশার কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে সনদটি এখনো রাজনৈতিক বিতর্ক ও সংশয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
মূল প্রশ্ন এখন সনদের বাস্তবায়ন। কমিশন চাইছে যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিতে, যাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নির্ধারণ করা যায়। তারা ভাবছে, একটি বিশেষ আদেশ জারি করে সেই আদেশের ভিত্তিতে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ক্ষমতা দেওয়া—অর্থাৎ সংসদ হিসেবে আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করার সুযোগ—এই দুটি দিককে কেন্দ্র করেই এখন কমিশনের চিন্তাভাবনা ঘুরছে।
তবে এই পুরো উদ্যোগের শুরুতেই একটি বাস্তব প্রশ্ন সামনে এসেছে—এই প্রক্রিয়া আসলে কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক? সত্য হলো, এই জুলাই সনদ প্রণয়নের আলোচনায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত অনুপস্থিত। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় তারা রাজনৈতিক দৃশ্যপটেই নেই। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোকেও আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। এর বাইরে যারা সনদে স্বাক্ষর করেছে, তাদের বেশির ভাগই ছোট দল—সাইনবোর্ড সর্বস্ব, যাদের গণভিত্তি নগণ্য। বাস্তবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে মূলত দুইটি উল্লেখযোগ্য দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
এই প্রক্রিয়া আসলে কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক? সত্য হলো, এই জুলাই সনদ প্রণয়নের আলোচনায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত অনুপস্থিত। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় তারা রাজনৈতিক দৃশ্যপটেই নেই। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোকেও আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। এর বাইরে যারা সনদে স্বাক্ষর করেছে, তাদের বেশির ভাগই ছোট দল—সাইনবোর্ড সর্বস্ব, যাদের গণভিত্তি নগণ্য। বাস্তবে এই পুরো প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে মূলত দুইটি উল্লেখযোগ্য দল—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এই সীমিত রাজনৈতিক পরিসরে তৈরি দলিলকে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ বলা কতটা যৌক্তিক? এমনকি যদি গণভোটের মাধ্যমে এটিকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়ও, তবু তা কতটা টেকসই বা সর্বজনগ্রাহ্য হবে—তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ, গণতন্ত্রে বৈধতা শুধু আইনি নয়, রাজনৈতিক ও নৈতিক স্বীকৃতির বিষয়ও বটে।
ঐকমত্য কমিশন অবশ্য বলছে, তারা যত দ্রুত সম্ভব সনদ বাস্তবায়নের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দিতে চায়। ইতোমধ্যে একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যা নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের দুটি বিকল্প প্রস্তাব—এক, পুরো সনদকে গণভোটে দেওয়া, দুই, আংশিক প্রস্তাব বিশেষ আদেশে বাস্তবায়ন এবং বাকিগুলো গণভোটে পাঠানো। তবে গণভোটের প্রশ্ন, সময় ও প্রক্রিয়া—সবকিছু এখনো অনির্দিষ্ট।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘গণভোট’ শব্দটি শুনলেই অনেকের মনে ভর করে অবিশ্বাস। স্বাধীনতার পর দেশে যতগুলো গণভোট হয়েছে, তা মূলত শাসকগোষ্ঠীর হাতেই ছিল নিয়ন্ত্রিত। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের গণভোট, কিংবা ১৯৮৫ সালে এরশাদের—কোনোটিতেই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। বরং এগুলো ছিল ক্ষমতার বৈধতা প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক আয়োজন। জনগণও জানে, এসব গণভোট সাধারণত কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনে না, তাই অংশগ্রহণের আগ্রহও থাকে না। ইতিহাসের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এবারও অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এই গণভোট কি সত্যিই জনগণের মতামত যাচাইয়ের একটি গণতান্ত্রিক উদ্যোগ, নাকি আরেকটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া মাত্র?
এই প্রশ্ন আরও জটিল হয়ে উঠেছে কারণ, জুলাই সনদের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল। আওয়ামী লীগসহ বড় দলগুলো অনুপস্থিত; বাম দলগুলোর বড় অংশ সই করেনি। এমনকি বহুল আলোচিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিও এই দলিলে সই করেনি। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপি-জামায়াতের বাইরে গিয়ে তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। আপাতত বিএনপি ও জামায়াতের উপস্থিতিতে তৈরি এই ‘ঐকমত্য’ কতটা টেকসই হবে, তা নিয়েও সংশয় আছে। বিশেষত যদি ভবিষ্যতে ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের কোনো দল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে, তারা এই সনদকে স্বীকৃতি দেবে—এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। ফলে এখন যে আইনি ভিত্তি তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে, তা হয়তো কাগজে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার প্রভাব সীমিত হতে পারে।
তবু কমিশনের কাছে এই গণভোট এক ধরনের ‘অবধারিত পথ’। কারণ, সনদের প্রস্তাবগুলো রাষ্ট্রের মূল কাঠামো—সংবিধান, প্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা—সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত। এগুলো বাস্তবায়নে জনগণের সম্মতি ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়। কমিশন তাই চায়, গণভোটের আগে একটি ‘বিশেষ আদেশ’ জারি করা হোক, যাতে সনদের আইনি কাঠামো তৈরি হয় এবং গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট পেলে সেই আদেশ কার্যকর হয়ে যায়।
বিএনপির অবস্থান এখানে অপেক্ষাকৃত সরল। তারা মনে করে, একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে নতুন অধ্যাদেশের ভিত্তিতে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে এবং সেটি জাতীয় নির্বাচনের দিন একসঙ্গে করা উচিত। এতে সময় ও ব্যয় দুই-ই কমবে, এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদই সরাসরি সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে পারবে। তাদের যুক্তি—যদি জনগণ গণভোটে ‘হ্যাঁ’ দেয়, তাহলে পরবর্তী সরকার বাধ্য থাকবে সনদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি চায়, গণভোটের আগে ‘জুলাই বাস্তবায়ন আদেশ’ নামে একটি বিশেষ সরকারি আদেশ জারি হোক, যাতে সংসদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা ও সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা থাকে। তারা গণভোটকে জাতীয় নির্বাচনের আগে দেখতে চায়, যেন জনগণের রায় প্রথমে স্পষ্ট হয় এবং নতুন সংসদ সেই রায়ের ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে পারে। এনসিপির মতে, জনগণ সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের ইচ্ছা দেখিয়েছে, সেটিকে আইনি কাঠামোর মধ্যে সংহত করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা এত সরল নয়। কয়েকটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল অনুপস্থিত থাকায় গণভোট যদি অনুষ্ঠিতও হয়, তা যে জাতীয় সংহতির পরিবর্তে নতুন বিভাজন সৃষ্টি করবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, যারা প্রক্রিয়ায় বাইরে আছে, তারা পরবর্তীকালে গণভোটের ফলাফল মানবে কি না—সে নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘গণভোট’ শব্দটি প্রায়ই ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, গণতন্ত্রের নয়। ফলে জনগণের একাংশের মধ্যেও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে—এবারও কি সেটাই হতে যাচ্ছে?
গণভোট আয়োজন মানে একটি বিশাল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা—সবকিছুকে জড়িত হতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জনগণ আদৌ এতে আগ্রহী হবে কি না? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ক্রমশ কমেছে; রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। এমন পরিস্থিতিতে গণভোটে যদি ভোটাররা অংশ না নেয়, তাহলে সনদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আরেকটি দিক হলো, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলেও সনদের প্রয়োগে নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ, এতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে। যদি নতুন সংসদকে বিশেষ ক্ষমতা না দেওয়া হয়, তাহলে আদালতে এসব পরিবর্তন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কমিশন তাই চায়, আগামী সংসদকে ‘দ্বৈত ভূমিকা’—অর্থাৎ সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ—দুয়ের দায়িত্ব দেওয়া হোক। এতে আইনগত সুরক্ষা বাড়বে, তবে রাজনৈতিক বিতর্কও তীব্র হতে পারে।
সব মিলিয়ে জুলাই সনদ এখন বাংলাদেশের রাজনীতির এক অনিশ্চিত মাইলফলক। এতে যে ভাবনা ও আদর্শিক সাহস আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে এই সনদ কতদূর এগোতে পারবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও জনগণের অংশগ্রহণের ওপর। একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনৈতিক দল বাইরে থাকলে, গণভোট যতই আইনি বৈধতা পাক না কেন, তা হবে একটি অর্ধেক গণতান্ত্রিক প্রয়াস।
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণভোট কখনো জনগণের উৎসব হয়নি—এটি ছিল শাসনকর্তার আনুষ্ঠানিকতা, ক্ষমতার বৈধতা অর্জনের এক প্রাতিষ্ঠানিক অভিনয়। এবারও যদি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে জুলাই সনদ হয়তো কাগজে থাকবে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো রাজনৈতিক প্রাণ থাকবে না। আর যদি সত্যিই জনগণ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, যদি গণভোট প্রথমবারের মতো তাদের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়, তবে সেটিই হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন এক সূচনা।
সবশেষে প্রশ্নটি রয়ে যায়—এই গণভোট কি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গড়বে, নাকি কেবল আরেকটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক আয়োজন হয়ে থেমে যাবে? সময়ই সেই উত্তর দেবে, কিন্তু জনগণ যদি এবারও নীরব থাকে, তবে জুলাই সনদও হয়তো হয়ে থাকবে আরেকটি সুন্দর কিন্তু অকার্যকর কল্পনা—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অসংখ্য অসমাপ্ত স্বপ্নের মতো।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম