উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছিল এক ভয়ংকর ব্যাধি—টাইফয়েড জ্বর। বিশুদ্ধ পানির অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং জনসচেতনতার অভাবে মুহূর্তেই এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া টাইফয়েডের প্রতিষেধক উদ্ভাবন ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জগুলোকেই শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছিলেন কিছু বিজ্ঞানী। তাদের প্রাণান্ত চেষ্টার ফলে ১২৯ বছর আগে জন্ম নেয় টাইফয়েড টিকা, যা আজ হয়ে উঠেছে সারাবিশ্বের জন্য আশীর্বাদ।
টাইফয়েডের ভয়াবহতা ও প্রাথমিক গবেষণা
টাইফয়েড জ্বর ‘সালমোনেলা টাইফি’ নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাদ্যের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে। উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, পেটব্যথা, এমনকি অন্ত্র ফেটে যাওয়া—এসব ছিল এই রোগের সাধারণ উপসর্গ। চিকিৎসা ব্যবস্থা তখনো দুর্বল, ফলে ইউরোপে এটি প্রায় মহামারির রূপ নেয়।
১৮৮০ সালে জার্মান চিকিৎসক কার্ল জোসেফ এবের্থ প্রথমবারের মতো টাইফয়েডের জীবাণু শনাক্ত করেন। এরপর ১৮৮৪ সালে তারই সহকর্মী জর্জ গ্যাফকি সফলভাবে ব্যাকটেরিয়াটি পৃথক করে পরীক্ষাগারে চাষ করতে সক্ষম হন। এই আবিষ্কারটাই পরবর্তী প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
আরও পড়ুন>>
দেশে প্রথমবারের মতো টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শুরু
জন্মনিবন্ধন ছাড়াই টাইফয়েড টিকা মিলবে উত্তর সিটিতে
স্কুলে স্কুলে দেওয়া হবে টাইফয়েডের টিকা, রেজিস্ট্রেশন করবেন যেভাবে
প্রথম টিকার জন্ম
১৮৯৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক আলমরথ এডওয়ার্ড রাইট প্রথম কার্যকর টাইফয়েড টিকা তৈরি করেন। তিনি মৃত টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে একটি ‘কিলড ভ্যাকসিন’ তৈরি করেন, যা শরীরে ইনজেকশন দেওয়ার পর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
এই টিকা প্রথম ব্যবহৃত হয় ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার বোর যুদ্ধ চলাকালে। টিকা নেওয়া সৈন্যদের মধ্যে টাইফয়েডে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। রাইটের এই সাফল্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে টিকা প্রযুক্তির এক নতুন যুগের সূচনা করে।
আধুনিক টিকার অগ্রযাত্রা: ইউরোপ থেকে ভারত
রাইটের প্রাথমিক আবিষ্কারের পর টাইফয়েড টিকা আরও কার্যকর, নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা চলতে থাকে।
টিওয়াই২১এ — মুখে খাওয়ার টিকা
১৯৭০-এর দশকে সুইস ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটের গবেষকরা তৈরি করেন ‘টিওয়াই২১এ’, যা ছিল এক প্রকার দুর্বল ব্যাকটেরিয়াভিত্তিক টিকা। এটি মুখে খাওয়ার জন্য তৈরি করা হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম ছিল। পরে টিকাটি বাজারজাত করে বারনা বায়োটেক, যা পরে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পায়।
ভি পলিস্যাকারাইড — ইনজেকশন টিকা
১৯৮০–১৯৯০-এর দশকে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের গবেষক দল ‘ভি ক্যাপসুলার অ্যান্টিজেন’–এর ভিত্তিতে আরেকটি আধুনিক টিকা তৈরি করে। এটি শরীরে ইনজেকশন দিয়ে দেওয়া হয় এবং সাধারণত দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই টিকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়।
টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) — নতুন প্রজন্মের টিকা
টাইফয়েড টিকা প্রযুক্তির সর্বশেষ ধাপ হলো ‘টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন’ (টিসিভি)। আন্তর্জাতিক গবেষণা অংশীদারদের সহযোগিতায় টাইপবার-টিসিভি তৈরি করে ভারতের ‘ভারত বায়োটেক’। ২০১৮ সালে ডব্লিউএইচও এই টিকাকে প্রাক-যোগ্যতা দেয়, ফলে এটি বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের অনুমতি পায়।
২০২০ সালের শেষের দিকে টাইফিবেভ নামে আরেকটি টিসিভি তৈরি করে ভারতের আরেক সংস্থা বায়োলজিক্যাল-ই। ওই বছরই ডব্লিউএইচও এটিকে প্রাক-যোগ্যতা দেয়। এটি অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী টাইফয়েড স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কার্যকর এবং বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহার হয়।
টাইফয়েড টিকার উপকারিতা
- রোগ প্রতিরোধে কার্যকর: টিকা শরীরে সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
- জটিলতা প্রতিরোধ: টাইফয়েড চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় অন্ত্র ফেটে যাওয়া, রক্তদূষণ বা দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। টিকা নেওয়া থাকলে এসব ঝুঁকি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।
- জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা: যেসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের ঘাটতি রয়েছে, সেখানে টিকাদান জনস্বাস্থ্যের এক কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। এটি শুধু ব্যক্তিকে নয়, পুরো সম্প্রদায়কেও রোগের বিস্তার থেকে রক্ষা করে।
- শিশু ও ভ্রমণকারীদের সুরক্ষা: দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার মতো টাইফয়েড-প্রবণ অঞ্চলে শিশু ও বিদেশি ভ্রমণকারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে। টিকা এই ঝুঁকি কার্যকরভাবে কমায়।
- দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা: ভি টিকা সাধারণত দুই থেকে তিন বছর, আর টিসিভি টিকা পাঁচ বছরের বেশি সময় সুরক্ষা দেয়। বুস্টার ডোজ নিলে সুরক্ষা আরও দীর্ঘ হতে পারে।
বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি
বাংলাদেশে পানি ও খাদ্যবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো টাইফয়েড। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন এবং এতে প্রায় ৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া এ রোগে যারা মারা যায় তাদের ৬৮ শতাংশই শিশু।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি চলছে এখন। এতে মাত্র দুইদিনে ৩২ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি শিশু, কিশোর ও কিশোরী এই টিকা নিয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রচারে বলা হয়েছে, টিকাটি নিরাপদ ও কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যাচাই করা এবং সৌদি হালাল সেন্টার কর্তৃক হালাল সনদপ্রাপ্ত।
টাইফয়েড টিকা বাংলাদেশে ২০০০ সালের দিক থেকেই বেসরকারিভাবে পাওয়া যাচ্ছিলো। তবে মানুষের মধ্যে এই টিকা গ্রহণের আগ্রহ খুব একটা দেখা যায়নি। সাধারণত শিশুর জন্মের ৪৫ দিন পর থেকে সরকারিভাবে যেসব টিকা দেয়া হয় তার মধ্যেও টাইফয়েডের টিকা ছিল না।
প্রসঙ্গত, সরকার দেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু, কিশোর-কিশোরীদের বিনামূল্যে এই টিকা দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ১৮ দিনের এই টিকাদান কর্মসূচির লক্ষ্য ৪ কোটি ৯০ লাখ শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া।
ইপিআই (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি) প্রোগ্রামের ম্যানেজার ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দিন খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বা টিসিভি নামে এই টিকাটি ভারতের বায়োলজিক্যাল-ই কোম্পানির উৎপাদন করেছে। তবে এর পেটেন্ট হলো বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত ব্রিটিশ ঔষধ কোম্পানি জিএসকের।
বাংলাদেশ টাইফয়েড প্রতিরোধী এই টিকাটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন সহায়তা সংস্থা গ্যাভির মাধ্যমে। এক ডোজের ইনজেকটেবল এই টিকা তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত টাইফয়েড থেকে শিশুদের সুরক্ষা দেবে বলে সরকারি প্রচারে বলা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, টাইফয়েড টিকা টিসিভি বাংলাদেশে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ নয়। ২০২০ সাল থেকেই এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যাচাই করা এবং এটি নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত।
বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ২০১৯ সাল এবং নেপাল ২০২২ সাল থেকে শিশুদের এই টাইফয়েড টিকা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আটটি দেশে শিশুদের এই টিকা দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ জানান, টাইফয়েডের জীবাণু ক্রমশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। ফলে আগে কার্যকর ছিল এমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এখন আর কাজ করে না। এই প্রেক্ষাপটে টাইফয়েডের টিকাদান একটি ভালো কর্মসূচি।
সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, উইকিপিডিয়া, বিবিসি বাংলা
কেএএ/