সময়ের চলতি পথে কত কিছু ঘটে যায়! কিছু আগে, কিছু পরে। তবে সময় এবং স্রোত যেমন কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তেমনি সময়ের প্রবাহমানতায় ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই মানুষের জীবনে এক একটা মাইলফলক হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে হয়তো ঘটনাগুলো থেকে বর্তমান সময়ের দূরত্ব বাড়তে থাকে; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চির হিরন্ময় হয়ে থাকে সাফল্য-ব্যর্থতায় ভরা প্রতিটি ঘটনাবলী।
২০২৪: পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম জয়
বর্তমান সময়ের সঙ্গে হয়তো দূরত্বটা খুব বেশি তৈরি হয়নি। মাত্রই এক বছর আগের ঘটনা। আজকের এই দিনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। পাকিস্তানের মাটিতেই স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রথম টেস্ট জয়। রাওয়ালপিন্ডিতে গত বছর ঠিক এই দিনেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল নাজমুল হোসেন শান্ত অ্যান্ড কোং।
রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ ১০ উইকেটে দাপুটে জয় তুলে নেয়। যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রথম ইনিংসে পাকিস্তান সৌদ শাকিল এবং মোহাম্মদ রিজওয়ানের বিশাল সেঞ্চুরির সুবাদে ৬ উইকেটে ৪৪৮ রান তুলে অপ্রত্যাশিতভাবে ইনিংস ঘোষণা করে। হয়তো তারা ভেবেছিল, পিচের তীক্ষ্ণ আচরণ বাংলাদেশের ব্যাটারদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। কিন্তু পিচটি অন্য সবসময়ের মতোই ফ্ল্যাট ছিল।
মুশফিকুর রহিমের দুর্দান্ত ১৯১ রানে ভর করে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে বড় লিড নেয়। বাংলাদেশ করেছিল ৫৬৫ রান। এরপর মেহেদি হাসান মিরাজ (৪) এবং সাকিব আল হাসানের (৩) দুরন্ত স্পিন বোলিংয়ে পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৪৬ রানে গুটিয়ে যায়।
ফলে বাংলাদেশের সামনে মাত্র ৩০ রানের লক্ষ্য দাঁড়ায়। যা জাকির হাসান ও সামদান ইসলাম মিলে বিনা উইকেটে সহজেই পার করে জয় নিশ্চিত করে। এটি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র তৃতীয় ঘটনা, যেখানে কোনো দল প্রথম ইনিংসে ছয় বা তার কম উইকেট হারিয়ে ইনিংস ঘোষণা করার পরও ম্যাচ হেরেছে।
১৯৭১: ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের প্রথম জয়
ভারতীয় ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডের মাটিতে তাদের প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছে এই দিনে। ওভালে অনুষ্ঠিত সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে জিতে ভারত ১-০ ব্যবধানে সিরিজও জয় করে। সে সঙ্গে ইংল্যান্ডের ২৬ টেস্টের অপরাজিত থাকার রেকর্ডের অবসান ঘটিয়েছে।
প্রথম ইনিংসে ৭১ রানে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় দল দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। লেগস্পিনার ভাগবত চন্দ্রশেখরের দুরন্ত বোলিংয়ের সামনে ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১০১ রানে গুটিয়ে যায়, যা ভারতের বিপক্ষে তাদের সর্বনিম্ন স্কোর। চন্দ্রশেখর একাই ৬ উইকেট তুলে নেন মাত্র ৩৮ রানের বিনিময়ে।
১৭৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ভারতের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক রে ইলিংওয়ার্থ। ধীরগতির এবং টার্নিং পিচে তিনি দারুণ বোলিং করেন এবং আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজান। তবে, দেড়দিন সময় হাতে নিয়ে ভারত শেষ ৯৭ রান তিন ঘণ্টায় তুলে নেয়। শেষ পর্যন্ত তারা লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ৬ উইকেট হারিয়ে এবং ৪ উইকেটে ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করে।
২০১৫: কুমার সাঙ্গাকারার বিদায়ী টেস্ট ও শ্রীলঙ্কার বড় পরাজয়
আজকের দিনটি ছিল শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ক্রিকেটার কুমার সাঙ্গাকারার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচের দিন। টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর জন্য তিনি যেভাবে কল্পনা করেছিলেন, তেমনটা হয়নি। বরং, লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছিল লঙ্কানদের। কলম্বোর পি সারা ওভালে ভারতের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা ২৭৮ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়।
সাঙ্গাকারা তার শেষ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৩২ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৮ রান করেন। যদিও তা তার অসাধারণ ক্যারিয়ারের মহিমাকে ম্লান করতে পারেনি।ভারতের প্রথম ইনিংসে লোকেশ রাহুলের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১০৮), সঙ্গে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা এবং ঋদ্ধিমান সাহার হাফ-সেঞ্চুরির সুবাদে দলটি ৩৯৩ রানের মজবুত ভিত গড়ে তোলে।
শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ তার ক্যারিয়ারে পঞ্চম সেঞ্চুরি (১০২) করলেও ভারতকে বড় লিড নিতে আটকাতে পারেননি। ৩০৬ রানে অলআউট হয় লঙ্কানরা।
ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে মুরালি বিজয়ের ৮২ এবং আজিঙ্কা রাহানের ১২৬ রানের ইনিংস লিডকে আরও বাড়িয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪১৩ রানের।
জবাবে ব্যাট করতে নামা শ্রীলঙ্কার ব্যাটারদের ওপর ভারতের স্পিনাররা আধিপত্য বিস্তার করেন। অমিত মিশ্র এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন দুজনেই সাতটি করে (দুই ইনিংস মিলিয়ে) উইকেট নেন। উল্লেখ্য, অশ্বিন এই সিরিজের দুই টেস্টেই সাঙ্গাকারার উইকেট তুলে নিয়েছেন। এই ম্যাচ দিয়ে কুমার সাঙ্গাকারা তার গৌরবময় টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন। তার বিদায়ী মুহূর্ত হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি, তবে তিনি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের এক অমর নক্ষত্র হিসেবে থাকবেন।
১৯৭৩: লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস জয়, সোবার্সের নাটকীয় ইনিংস
ঐতিহাসিক লর্ডস স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডকে এক ইনিংস ও ২২৬ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৮ উইকেটে ৬৫২ রানের বিশাল স্কোরের পেছনে ছিলেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার গ্যারি সোবার্সের অবিশ্বাস্য অবদান। ১৫০ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।
তবে, এই ইনিংসের পেছনে রয়েছে একটি চমকপ্রদ গল্প। সোবার্স পরে স্বীকার করেছেন, প্রথম দিনের খেলা শেষে তিনি যখন ৩১ রানে অপরাজিত ছিলেন, তখন তিনি সারা রাত পোর্ট এবং ব্র্যান্ডি পান করে কাটিয়েছিলেন। ফলে, পরেরদিন ব্যাটিংয়ে নামার সময় তিনি শারীরিকভাবে ভালো অবস্থায় ছিলেন না।
উইজডেনের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি পেটের সমস্যার কারণে মাঠ ছাড়েন; কিন্তু সোবার্স নিজে জানিয়েছেন, তিনি বমি হওয়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তবুও তার অসাধারণ ইনিংস ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুর্দান্ত জয় এনে দেয়।
এই ম্যাচে হার দিয়ে ইংল্যান্ড ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হারে, যা ইংল্যান্ড অধিনায়ক রে ইলিংওয়ার্থের টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটায়। তার স্থলাভিষিক্ত হন মাইক ডেনেস।
আইএইচএস/