ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ বা ডাকসুর এবারের নির্বাচনটি অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে নানা কারণেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি স্পর্শকাতর। বলা হচ্ছে, এটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটা রিহার্সাল। কিন্তু কেন? সেই কেনর উত্তর খুঁজতে যাওয়ার আগে আমরা একটু নজর দিতে চাই ডাকসুর সবশেষ নির্বাচনে।
ডাকসুতে সবশেষ নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে। তার আগের বছর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লাইমলাইটে চলে আসেন নুরুল হক নুর। তিনি ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে জয়ী হলে ভিপি শব্দটি তার নামের অংশ হয়ে যায়। এখনও মানুষ তাকে ভিপি নুর বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু ভিপি নুরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ভিপি হওয়ার আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়া শুরু করেন—যা অব্যাহত থাকে ভিপি হওয়ার পরেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদের ভিপি থাকা অবস্থায় কেউ তার গায়ে হাত তুলতে পারে, এটি একসময় অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। কিন্তু নুরের বেলায় সেটি ঘটেছে। পরবর্তীতে ভিপি নুর চব্বিশের জুলাই আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন এবং তখনও তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি অভ্যুত্থানের মুখে সরকারের পতন হওয়ার পরে গঠিত নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও ভিপি নুর মার খেয়েছেন। সবশেষ মারটা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, তাকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন।
ডাকসু নির্বাচনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নুরকে নিয়ে এত কথা বলাটাকে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়া মনে হতে পারে। কিন্তু এই প্রসঙ্গ অবতারণার একটা কারণ রয়েছে। সেটি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার শিক্ষার্থী সংসদের গুরুত্ব বোঝানো। নুর যদি ২০১৯ সালের নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে ভিপি পদে জয়ী না হতেন; যদি তিনি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হতেন—তাহলে তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন অন্যরকম হতে পারতো।
এবার অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম যে নির্বাচনটি হচ্ছে, সেটির অকুস্থল দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এবারের নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাসীন দলের প্যানেল নেই। কেননা এই মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দল ক্ষমতায় নেই। কোনো কোনো দল ও সংগঠনকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্টেকহোল্ডার বলে মনে করা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই সরকারি দল সমর্থিত বা সরকারি দলের প্রার্থী নন। ফলে এবারের নির্বাচনটি ভিন্ন আবহের। ভিন্ন দ্যোতনার।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ১৯৭১ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরাজিত পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বয়ান প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা গত এক বছর ধরে চলছে—তার আঁচ থেকে দেশের এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠও মুক্ত থাকতে পারেনি। বরং অভ্যুত্থানের সময়ে এই ক্যাম্পাসেই ‘তুমি কে আমি রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেয়া হয়েছে। যদিও তার পক্ষে কিছু যুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে।
গত এক বছরে দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠী যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে; তারা তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে যেভাবে সক্রিয় হয়েছে—তারই ধারাবাহিকতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই পোশাকের কারণে একজন ছাত্রীকে নিগৃহীত করার মতো ঘটনা ঘটেছে। আবার ওই নিগ্রহের অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে জেলগেট থেকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করার মতো লজ্জার উদাহরণও তৈরি হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং জ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত এই ক্যাম্পাসেই একজন প্রার্থীকে প্রকাশ্যে গণধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে।
যখন ডাকসু সচল ছিল, তখন এই সংগঠনই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। সুতরাং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচনকে শুধু এই ক্যাম্পাসের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। বরং এর ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য জাতীয় রাজনীতি ও সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কম নয়। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতার একটা ছোট পরীক্ষা যেমন হবে, তেমনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা তাদের নেতা নির্বাচন তথা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নেতৃত্ব কাদের হাতে তুলে দিতে চান—তারও একটা কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন।
সুতরাং, এবারের ডাকসু নির্বাচন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের অস্তিত্ব, নারী অধিকার ও মর্যাদা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞান ও নেতৃত্ব বিকাশের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক ও সহনশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে অনিঃশেষ লড়াই—তারও একটা বড় পরীক্ষা নিঃসন্দেহে।
এই সময়ের বাংলাদেশে সবচেয়ে সক্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে যে দল বিতর্কিত এবং মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় যে দলকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—সেই দলের প্রার্থীরা এবার অতীতের যেকোনো সময়ের অনেক বেশি সক্রিয়, সোচ্চার। এই দলের অনেকে জয়ী হয়ে যাবেন—এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন বা দেবেন না—সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ও এখতিয়ার একান্তই তাদের এটা যেমন ঠিক, তেমনি দেশের প্রশ্নে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো দোটানা থাকাও উচিত নয়।
ডাকসু নির্বাচন অনেকগুলো কারণেই আগামীর বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। এই নির্বাচন কেমন হবে বা শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার কতটা শান্তিপূর্ণভাবে এই ভোট সম্পন্ন করতে পারে এবং ভোটের ফলাফল কতটা বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হবে—তারওপর অনেকটা নির্ভর করবে অব্যবহিত পরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটের ফলাফল ও পরিবেশ। এরপর রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনেও ডাকসু নির্বাচনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থাকবে—তাতে সন্দেহ নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, এই নির্বাচনটি একটি ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং স্থানীয় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে অনেক ছোট আয়োজনে হলেও এটা নির্বাচন সম্পন্নে সরকারের সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতার মর্নিং শোজ দ্য ডে হিসেবে গণ্য হবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে একদিনে তিনশো আসনে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনীর বিপুল সংখ্যক লোক মোতায়েন থাকবে। রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহর ছাড়িয়ে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নজরদারি অনেক কঠিন। ফলে তার সঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচনের তুলনা চলে না। কিন্তু তারপরও একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় হাঁড়ির সব ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা।
দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ-ডাকসুর গুরুত্ব বিবেচনায় একে অনেক সময় বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তার কারণ ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সবশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন।
যখন ডাকসু সচল ছিল, তখন এই সংগঠনই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। সুতরাং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচনকে শুধু এই ক্যাম্পাসের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। বরং এর ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য জাতীয় রাজনীতি ও সংসদ নির্বাচনের চেয়ে কম নয়। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতার একটা ছোট পরীক্ষা যেমন হবে, তেমনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা তাদের নেতা নির্বাচন তথা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নেতৃত্ব কাদের হাতে তুলে দিতে চান—তারও একটা কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন।
স্রষ্টা আপনাদের পরীক্ষা সহজ করে দিন। দিন শেষে দেশ ও মানুষের জয় হোক। এই ক্যাম্পাসে কেউ দেশবিরোধী স্লোগান দেওয়ার সাহস না পাক। কেউ তার সহপাঠীকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার সাহস না পাক। শুধু সাহস নয়, এই মানসিকতাই যাতে কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে না ওঠে এবং এরকম নোংরা চিন্তা ও মানসিকতার কেউ যাতে ক্যাম্পাসের ধারেকাছেও ঘেঁষতে না পারে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।
এইচআর/জেআইএম