ডাকসুর নির্বাচনের মাত্র একদিন বাকি। প্রচার-প্রচারণা শেষে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভিপি পদে কে এগিয়ে, জিএস পদেই বা কার জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তা নিয়ে হিসাব কষছেন সবাই। প্যানেলগুলোও নিজেদের প্রার্থীদের কার অবস্থান কেমন, তা বিশ্লেষণে ব্যস্ত।
প্রচারণা শেষ হলেও সবার নজর এখন ছাত্রীদের ভোটের দিকে। কারণ ডাকসুতে এবার মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশই ছাত্রী ভোটার। ফলে উত্তাপ ছড়ানো এ নির্বাচনে বড় পদগুলোর প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন ছাত্রীরাই।
ছাত্রীদের ভোট কত, কোন হলে কত ভোটার
ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এরমধ্যে ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯টি, যা মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ছাত্রীদের পাঁচটি আবাসিক হলের মধ্যে শুধু রোকেয়া হলেই ৫ হাজার ৬৬৫ ভোট।
- আরও পড়ুন
- ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিন আজ
- ডাকসু নির্বাচনে কোচিং ‘ফ্যাক্টর’: আবিদ-সাদিক-শামীমের ‘ভোটব্যাংক’
- মেয়েরাই ডাকসুতে ব্যবধান গড়ে দেওয়ার বড় ফ্যাক্টর
এছাড়া বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ২ হাজার ১১০টি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ২ হাজার ৬৪৫, শামসুন নাহার হলে ৪ হাজার ৯৬ এবং কবি সুফিয়া কামাল হলে ভোটার ৪ হাজার ৪৪৩টি।
ছাত্রী হলে প্রচারণায় সরব আবিদ-সাদিক-উমামা
ছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোতে প্রবেশে বিধি-নিষেধ রয়েছে। ফলে পুরুষ প্রার্থীরা চাইলেই যখন-তখন প্রবেশ করতে পারছেন না। তবে প্রত্যেক প্যানেলকে প্রজেকশন মিটিং নামে একদিন করে প্রচারণা চালানোর অনুমতি রয়েছে। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা সব কয়টি হলে প্রজেকশন মিটিং করেছেন। ছাত্রীদের জন্য তারা কী করবেন, সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন।
নারী প্রার্থীদের মধ্যে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা ও বামসংগঠনগুলোর প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি হলগুলোতে প্রচারণা চালিয়েছেন। ছাত্রী হিসেবে তারা হলগুলোতে প্রবেশ করে ভোটারদের কক্ষে কক্ষে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
তবে ছাত্রদলের নেত্রীরাও তাদের দল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের জন্য সক্রিয়ভাবে হলে হলে কাজ করছেন। পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের পক্ষে হলে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন ইসলামী ছাত্রীসংস্থার কর্মীরা। নারীদের হলগুলোতে ছাত্রীসংস্থার শক্ত অবস্থান রয়েছে বলে জানা গেছে।
জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন ছাত্রীরাই-ছবি জাগো নিউজ
ছাত্রীদের জন্য কার ইশতেহারে কী প্রতিশ্রুতি
ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণায় প্রথম থেকেই গুরুত্ব পাচ্ছে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন সব প্যানেলের প্রার্থীরা। একই সঙ্গে নারীরা যাতে সাইবার বুলিংয়ের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করার কথাও বলছেন সবাই।
ছাত্রদল সমর্থিত আবিদ-হামীম প্যানেলের ইশতেহারে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি হলে স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট, মেডিকেল সেন্টারে নারী চিকিৎসকের উপস্থিতি, সান্ধ্য আইন বিলোপ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে।
- আরও পড়ুন
- ডাকসুকে অরাজনৈতিক করতে চাওয়া গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ
- ভিপি পদে লড়া ৪৩ প্রার্থীর অধিকাংশই ‘আড়ালে’, আলোচনায় ৯ মুখ
ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সাদিক-ফরহাদ প্যানেলের ৩৬ দফা ইশতেহারে ৭টিতে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সেগুলো হলো-নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা করা, ছাত্রী হলে নারী কর্মচারী ও নারী প্রক্টর নিয়োগ, অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশাধিকার দেয়া এবং অভিভাবকদের জন্য ‘গার্ডিয়ান লাউঞ্জ’ তৈরি।
মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর করা। এসময় পরীক্ষায় অংশ নিতে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা শিথিল করা। কমনরুমে নারী কর্মচারী রাখা, ব্রেস্টফিডিং রুম ও চাইল্ড কেয়ার কর্নার স্থাপন। যৌন হয়রানি ও সাইবার বুলিং প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন ও আইনি সহায়তা। ফ্রি মেন্সট্রুয়াল হাইজিন প্রোডাক্ট একাডেমিক ভবনে সহজলভ্য করা। নারী শিক্ষার্থীদের সেলফ ডিফেন্স প্রশিক্ষণ চালু করা।
বাগছাস সমর্থিত কাদের-বাকের প্যানেলের ইশতেহারে নারীদের হলগুলোতে খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু, মেয়েদের নামাজের স্থান সম্প্রসারণ, অনাবাসিক নারীদের হলে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, জনপরিসর নারীবান্ধব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের উমামা-সাদী প্যানেল তাদের ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কার্যকর করা, আইনি সহায়তা সেল গঠন, সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠন, অনলাইন-অফলাইনে নিপীড়ন বা বুলিংয়ের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ছাত্রীদের জন্য সবার ইশতেহারেই আছে প্রতিশ্রুতি-ছবি জাগো নিউজ
বামজোটের প্রতিরোধ পর্ষদের ইমি-মেঘমল্লার প্যানেলের ইশতেহারে নারীবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরি, সাইবার নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, যৌন হয়রানিবিরোধী সেল কার্যকর করা, স্বাস্থ্য ও মাতৃত্বকালীন সহায়তাকেন্দ্র স্থাপন, নারী হলে অযৌক্তিক নিয়মকানুন বাতিল, রাতের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করা হবে।
ছাত্রীদের চাওয়া কী, কাকে ভোট দেবেন
বিভিন্ন প্যানেল যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তা পর্যালোচনা করছেন ছাত্রীরা। তারা বলছেন, যাদের ভোট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ হবে, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে এবং সংঘাত কমবে- এমন প্রার্থীদের তারা বেছে নেবেন। পাশাপাশি নিরাপদ ক্যাম্পাস, মতপ্রকাশ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক; এটাই চাওয়া ছাত্রীদের।
বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নাজনীন নাহার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবার ইশতেহারে নারীদের জন্য অনেক কথা রয়েছে। তবে এগুলো নির্বাচনের পর আদৌও বাস্তবায়ন করা হবে কি না, তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। সেজন্য যারা তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে মনে করছি, তাদের ভোট দেবো।’
শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থী সেঁজুতি পারভীন বলেন, ‘আমরা মূলত নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই। ক্যাম্পাসে বের হয়ে যাতে কোনো ছাত্রীকে হয়রানির শিকার হতে না হয়। কেউ জিন্স-টপস পরলেও কেউ যেন তাকে হয়রানি না করে; আবার কেউ হিজাব-নিকাব পরলেও তাকে যেন কেউ কটাক্ষ না করেন; এটাই আমাদের চাওয়া। কারা এটা নিশ্চিত করতে পারবে, সে বিবেচনা থেকে ছাত্রীরা ভোট দেবে।’
মিরপুরে পরিবারের সঙ্গে থাকেন সাঈয়েদা আক্তার মিম। তিনি ঢাবির যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি ক্যাম্পাসে বাসে করে যাতায়াত করেন। বাস ধরতে তাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় জানিয়ে মিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা এই পরিবহনের সমস্যাটা ঠিক করে দেবে, তাদেরই আমি ভোট দেবো।’
ছাত্রীদের কার কোন কেন্দ্রে ভোট
ডাকসু নির্বাচনে এবার মোট আটটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। এরমধ্যে চারটি কেন্দ্রে ছাত্রীদের পাঁচটি হলের ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। সেগুলো হলো-টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, ভূতত্ত্ব বিভাগ ও ইউল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
টিএসসি কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্রে ভোট দেবেন বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ছাত্রীরা। ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্রে কবি সুফিয়া কামাল হল এবং ইউ ল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজ: শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে পারবেন।
এএএইচ/এসএনআর/জিকেএস