নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা থেকে সদরে পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন আরিফ নামের এক যুবক। অফিসে ডেস্কে গিয়ে জানতে পারেন তার পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট এখনো জমা হয়নি। এ জন্য তাকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেয়।
পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করতেই আরিফের সঙ্গে দেখা হয় কালবেলার এই প্রতিবেদকের। আরিফ জানান, পাসপোর্ট অফিস থেকে তার বাড়ির দূরত্ব ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। আর যাতায়াতের একমাত্র পথ হলো নৌযান। আবেদনের পর পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাকে কোনো কল বা মেসেজ দেওয়া হয়নি।
বিষয়টি জানতে পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রুমের সামনে গেলে দেখা মেলে অন্তত ১৫ জনের। তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, প্রত্যেকে আবেদন করেছেন নিজে, জমাও দিয়েছেন নিজে। কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হননি।
শিহাব নামে এক সেবাপ্রত্যাশী কালবেলাকে বলেন, কম্পিউটার দোকানে আবেদন করতে গেলে সে আমাকে বলে নিজে নিজে আবেদন করলে অনেক হয়রানি হতে হয়। আপনি আমাদের মাধ্যমে করাতে পারেন। কিন্তু আমি তাদের ফাঁদে পা দিইনি। নিজের আবেদন নিজেই জমা দিয়েছি। কোনো হয়রানি হতে হয়নি।
ওমান গমনেচ্ছু সুজন নামের এক যুবক বলেন, আমার ভাইয়ের মাধ্যমে কম্পিউটার দোকান থেকে আবেদন করা ছিল। কম্পিউটার দোকানদার হয়রানির ভয় দেখিয়ে আমার ভাইকে ভুল বুঝিয়ে বাড়তি ৩ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। তার পরও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে পেরে খুশি। ঘুষ নেওয়া কম্পিউটার দোকানির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতে রাজি হননি।
এমন চিত্রের দেখা মিলেছে নোয়াখালী পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে ও বাইরে।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ছিল দালালদের রমরমা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখানে গড়ে ১০০টি পাসপোর্টের মধ্যে অন্তত ৯০টি পাসপোর্ট তৈরি হতো দালালদের গোপন সংকেতের ভিত্তিতে। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ গোপন সংকেতের ভিত্তিতে পাসপোর্টের সিস্টেম চালু করেছিল পাসপোর্ট অফিসের সামনের কম্পিউটার দোকানগুলো। কম্পিউটার দোকানে আবেদন করতে গেলে তারা বলতেন যে, নিজে নিজে আবেদন করলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে আর তাদের মাধ্যমে করলে কোনো ঝামেলা ছাড়া দ্রুত পেয়ে যাবেন পাসপোর্ট। এমনকি পুলিশ ভেরিফিকেশনেও কোনো সমস্যা হবে না।
তখন মানুষ হয়রানির ভয়ে কম্পিউটার দোকানদার নির্দিষ্ট ফি ছাড়া বাড়তি আরও ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট করাত। এভাবে সেবাপ্রত্যাশীদের হয়রানির ভয় দেখিয়ে সিস্টেমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত দালাল চক্র। কম্পিউটার দোকান ছাড়াও কিছু আনসার সদস্য ও ভাসমান দালাল এ কাজে জড়িত ছিল।
তবে ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে কেমন চলছে নোয়াখালীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম, তা দেখতে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে আগের মতো না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কমেনি ভোগান্তি।
কারও আবেদনে কোনো ত্রুটির কারণে পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করা কর্মকর্তারা ফের আবেদন সংশোধন করে নিয়ে আসতে বললে তারা এ সুযোগ কাজে লাগান। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসৎ কর্মকর্তা আবেদনে ছোটখাটো ভুল ধরেই আবেদন বাতিল করে ফের আবেদন করতে বলেন। মূলত তাদের উদ্দেশ্য থাকত, যাতে সেবাপ্রত্যাশীরা দালালদের শরণাপন্ন হতে হয়।
সেবাপ্রত্যাশী, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য ও অবৈধভাবে টাকা লেনদেন অনেক কমে গেছে। তবে কম্পিউটার দোকানিরা মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানির কথা বলে পাসপোর্ট পাওয়ার চুক্তি করেন। এ জন্য নির্ধারিত ফির চেয়ে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।
ইউরোপ গমনেচ্ছু সুমন নামের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, প্রাথমিক আবেদন জমা দিলে সেখানে এনআইডির ভেরিফিকেশন কপিতে নির্বাচন কর্মকর্তার সিল সাইন না থাকায় ফের সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলা হয়। আমি সংশোধন করে নিয়ে এসেছি। এখন আবেদন জমা দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সম্পন্ন করেছি।
তবে প্রস্তুত হওয়া নতুন পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া কয়েকজন সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাউকে পুলিশের ডিএসবি শাখা থেকে কল বা মেসেজ দেওয়া হয়নি। তারা অনেকে নিজ থেকে ডিএসবি অফিসে যোগাযোগ করেছেন, আবার অনেকে পাসপোর্ট নিতে এসে জানতে পারেন পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়নি। তখন ডিএসবি অফিসে যোগাযোগ করে পুলিশ ভেরিফিকেশন করে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক নাহিদ নেওয়াজ কালবেলাকে বলেন, আমি শুনেছি আগে এ অফিসে ১০০টি পাসপোর্ট হলে ৯০টি পাসপোর্ট হতো রাজনৈতিক সিন্ডিকেট ও দালালদের মাধ্যমে। আমি যোগদান করেছি মাত্র দুই মাস হলো। এসে অফিসকে দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছি। কোনো কর্মকর্তা, স্টাফ বা আনসার সদস্য যদি ঘুষ নেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কম্পিউটার দোকানিদের বিষয়ে তিনি বলেন, শুনেছি অনেক অসাধু কম্পিউটার দোকানদার মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বাড়তি টাকা নেন। কোনো সেবাপ্রত্যাশী যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দোকানদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন, তাহলে প্রশাসনের কাছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করব। আমরা আন্তরিকভাবে সেবা দিতে সবসময় প্রস্তুত রয়েছি। তবে লোকবল সংকট এবং লজিস্টিক সাপোর্ট কম থাকায় মাঝে মাঝে সেবা ধীরগতিতে হয়।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তো আমার অফিস-সংশ্লিষ্ট নয়। এটা পুলিশের বিষয়। তার পরও আপনারা যেহেতু বলেছেন, আমি পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল ফারুক কালবেলাকে বলেন, আমি ৫ আগস্টের পর এ জেলায় যোগ দিয়েছি, তাই সবকিছু অবগত নই। তবে এর আগে এমন হয়রানি হয়েছে বলে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। যদি পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেউ কোনো ধরনের প্রতারণা করে, তাহলে তাদের নিস্তার নেই। পুলিশের ডিএসবি শাখা থেকে যদি এ ধরনের হয়রানি করা হয়, তাহলে খোঁজ নেব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেব।