দুর্বল পাঁচ ব্যাংক যেন গ্রাহকের দুঃস্বপ্ন

4 hours ago 4

বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি পাঁচ ব্যাংক। এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক কার্যত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বেতনের টাকাও তুলতে পারছেন না। ভেতরে-বাইরে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক ও হতাশা।

নীরব-সুনসান প্রায় সব শাখা

ঢাকার মতিঝিল, নয়াপল্টন ও সাতক্ষীরা জেলায় সরেজমিনে দেখা যায়—গ্রাহকের ভিড় থাকলেও লেনদেন প্রায় বন্ধ। প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ জন গ্রাহক টাকা তুলতে ব্যাংকে যাচ্ছেন, কিন্তু কাউকেই পূর্ণ অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। শাখা কর্মকর্তারা মন খারাপ করে বসে আছেন। অনেকে গ্রাহকের অনুরোধ, কান্নাকাটি দেখেও কিছুই করতে পারছেন না।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘মার্জারের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের সহায়তা বন্ধ রেখেছে। তাই এক মাস ধরে কাউকে কোনো টাকা ফেরত দিতে পারিনি। এমনকি আমাদের নিজেদের বেতনও তুলতে পারছি না।’

জীবনের প্রয়োজনেও মিলছে না টাকা

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের নয়াপল্টন শাখায় এক গ্রাহক বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। কয়েক দফা ঘোরাঘুরির পরও তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ পাননি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবার অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা চাহিদামতো তুলতে পারছি না। ব্যাংক থেকে যে অল্প টাকা দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা সম্ভব নয়।’

আরেক গ্রাহকের হৃদরোগের অপারেশনের জন্য ১১ লাখ টাকা দরকার ছিল। অনেক চেষ্টার পর ব্যাংক মাত্র দুই লাখ টাকা দিতে সক্ষম হয়েছে।

আমরা বহু প্রতিষ্ঠানের এফডিআরের টাকা ফেরত দিতে পারছি না। এমনকি ছোট ছোট আমানতকারীর টাকাও এ মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা চলছে।- ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. হুমায়ুন কবির

সীমিত উত্তোলন, অসহায় গ্রাহক

সাতক্ষীরার এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে তিন লাখ ২৩ হাজার ৫শ টাকা জমা থাকলেও তাকে বলা হয়েছে, সপ্তাহে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা তোলা যাবে। স্কুলশিক্ষক আবদুল কাদের ইউনিয়ন ব্যাংকে গিয়ে টানা ১৮ বার ঘুরেও নিজের জমানো এক লাখ ২৭ হাজার টাকার এক হাজার টাকাও তুলতে পারেননি।

আরও পড়ুন

সাদ্দাম হোসেন নামে একজন গ্রাহক বলেন, ‘আমার নিজের টাকা তুলতে ব্যাংকে গিয়ে ঘুরছি। ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছি। অথচ ব্যাংকে টাকা রেখেছিলাম সংকটের দিনে কাজে লাগবে বলে।’

কর্মকর্তারাও ভুক্তভোগী

শুধু গ্রাহক নন, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পড়েছেন একই সংকটে। এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মাস শেষে ৮০ হাজার টাকা বেতন আসে। কিন্তু বাস্তবে আমি এক হাজার টাকা করেও তুলতে পারি না। অন্য ব্যাংকের এটিএম ব্যবহার করলে প্রতিবার ১৫ টাকা ফি কাটা হয়। এখন সংসার চালাতে বন্ধুদের কাছে ঋণ চাইতে হচ্ছে।’

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বেতন অ্যাকাউন্টে যোগ হয়, কিন্তু ক্যাশ না থাকায় তুলতে পারছি না। সংসার খরচ, সন্তানদের পড়ালেখা, বাসাভাড়া—সবই চাপের মধ্যে চলছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ ও বাস্তবতা

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের (৫ আগস্ট, ২০২৪) পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। দুর্বল ব্যাংকগুলো বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্ষদ ভেঙে দেয়, ৫২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তাও দেয়। শুরুতে কিছুটা স্বস্তি এলেও এখন আবার সংকট গভীর হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে— পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা (৭৭ শতাংশ) এবং মূলধন ঘাটতি ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের গ্রাহক ৯২ লাখের বেশি। কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৫ হাজারের বেশি।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেন, ব্যাংকখাতের ৮০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

গ্রাহকের আমানতের শতভাগ সুরক্ষা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশের ব্যাংক ও আর্থিকখাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ও একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের শতভাগ আমানত ফেরতের নিশ্চয়তা দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি। এ লক্ষ্যে ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ–২০২৫’র পরিমার্জিত খসড়া অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

শিগগির একীভূতকরণ কার্যকর হবে। পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করা হবে। সরকার আর্থিক সহায়তা দেবে এবং পরবর্তীসময়ে লাভসহ সেই অর্থ ফেরত নিয়ে যাবে।- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান

এর আগে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৪১তম বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সরকারের ঘোষণায় একীভূত হচ্ছে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এর পর থেকে এসব ব্যাংকের ৯২ লাখ গ্রাহকের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আমানত তুলে নিতে শুরু করেন। এসব ব্যাংক একীভূত হোক বা না হোক, গ্রাহকদের সঞ্চয় শতভাগ ফেরত দেওয়া হবে। একই ধরনের সুরক্ষা পাবেন দেশের ১৬টি দুর্বল ও সংকটাপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকও।

মার্জারের অপেক্ষায় পাঁচ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলো একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। তবে এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক রাজি না হওয়ায় প্রক্রিয়া আটকে আছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মার্জার কার্যকর হলে অন্তত গ্রাহকের আস্থা কিছুটা ফিরতে পারে।

আমানতকারীরা এখন যেন এক অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে বন্দি। বহু মানুষ নিজের টাকায় চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পারছেন না। কর্মকর্তারাও পেশাগত মর্যাদা হারিয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। ব্যাংকখাতের এ সংকট শুধু গ্রাহক বা কর্মকর্তা নয়, পুরো অর্থনীতির জন্যই এক বড় অশনিসংকেত।

ব্যাংকখাতের সংকট

একীভূতকরণেই সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটিয়ে উঠতে মার্জারই একমাত্র পথ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে কেবল আমানতকারীর আস্থাই ফিরবে না, আর্থিক খাতেও কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে পাবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম, লুটপাট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের উদাসীনতার কারণেই ব্যাংকখাতে বর্তমান ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময় বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে আর্থিক সহায়তা দিতো। কিন্তু এখন সেই সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এই পাঁচ ব্যাংককে কেবল তারল্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দ্রুত একীভূতকরণ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।’

যা বলছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ

ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা বহু প্রতিষ্ঠানের এফডিআরের টাকা ফেরত দিতে পারছি না। এমনকি ছোট ছোট আমানতকারীর টাকাও এ মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা চলছে। নতুন আমানত আসছে না, পুরোনো বিনিয়োগের রিকভারি হচ্ছে না, ঋণ বিতরণেও অনিয়ম হয়েছে। সব মিলিয়ে ভাঙা ঘর পাহারা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি।’

তিনি দাবি করেন, ‘কর্মকর্তারা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন এবং বিভিন্ন স্কাবের মাধ্যমে টাকা তোলার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে আমানতকারীদের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক কার্যত অক্ষম।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান

সংকট সমাধানে আশাবাদী বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর ইতোমধ্যে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ব্যাংকগুলো একীভূত করার বিষয়ে সরকারের নীতিগত সম্মতি মিলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিগগির একীভূতকরণ কার্যকর হবে। পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠন করা হবে। সরকার আর্থিক সহায়তা দেবে এবং পরবর্তীসময়ে লাভসহ সেই অর্থ ফেরত নিয়ে যাবে।’

ইএআর/এএসএ/এসএফএ/এমএস

Read Entire Article