নারীদের হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম কেন হয়, কী করবেন

6 hours ago 3

নারীদের শরীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তির সময় সবচেয়ে বেশি যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম।

মেনোপজ ও হটফ্ল্যাশ কী?

একটানা ১২ মাস ধরে মাসিক না হওয়ার পর মেনোপজ নারীর জীবনের সেই সময়, যখন প্রজনন ক্ষমতা স্থায়ীভাবে শেষ হয়ে যায়। এ সময় ডিম্বাশয় থেকে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের নিঃসরণ কমে আসে, যা শরীর ও মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মায়ো ক্লিনিক, ইন্টারন্যাশনাল মেনোপজ সোসাইটিসহ আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী মেনোপজের সময় বিভিন্ন উপসর্গ অনুভব করেন, এর মধ্যে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নারী তীব্র বা ‘অ্যাকিউট’ উপসর্গে ভোগেন — যেমন ঘন ঘন হট ফ্ল্যাশ, অতিরিক্ত ঘাম, নিদ্রাহীনতা, হাড় ভেঙে যাওয়া বা হাড়ক্ষয়, এবং মানসিক অস্থিরতা।

এসময় এস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ায়, হৎস্পন্দনের হার আচমকা বেড়ে যায়, বুক ধড়ফড় করতে থাকে অনেকের। সেই সঙ্গে হঠাৎ অতিরিক্ত ঘাম হয়। অনেকে রাতে শুয়েও ঘামতে থাকেন। ঠান্ডা ঘরে বসেও প্রচণ্ড গরম লাগে। হট ফ্ল্যাশের কারণে ঘুমের ও বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে হট ফ্ল্যাশকে বলা হয় ‘ভ্যাসোমোটর সিম্পটম’ বা ভিএমএস।

সাধারণত ৪৫–৫৫ বছর বয়সে এই পরিবর্তন ঘটে। তবে হট ফ্ল্যাশ যে সব সময় মেনোপজ হওয়ার আগেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। মেনোপজের আগের দু-এক বছরের মধ্যে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমতে শুরু করে, তখন থেকে শুরু হতে পারে হট ফ্ল্যাশের উপসর্গ। হঠাৎ গরম লাগা, কান-মুখ গরম হয়ে ওঠা, ঘামতে থাকা আবার নিজে নিজে ঠিক হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া — এসবই হট ফ্ল্যাশের লক্ষণ।

নারীদের হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম কেন হয়, কী করবেন

বাংলাদেশের নারীদের মেনোপজের বয়স

বাংলাদেশের নারীদের প্রেক্ষাপটে সমস্যাটি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এখানে অনেক নারী নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন না, আবার পরিবার ও সমাজে বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করার সংস্কৃতিও কম। ফলে মেনোপজজনিত মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মতো সমস্যা আরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশে ‘কুষ্টিয়ার মধ্যবয়সী নারীদের মধ্যে মেনোপজজনিত উপসর্গের মূল্যায়ন’ নামক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেনোপজের গড় বয়স প্রায় ৪৯ থেকে ৫৩ বছর।

রিসার্চগেটে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা বলছে, ৩০-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে প্রায় ১৭.৯ শতাংশ নারী ‘আরলি মেনোপজ’-এ পৌঁছান, অর্থাৎ মেনোপজ ধরা পড়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আগেই।

মেনোপজের উপসর্গগুলো নারীর দৈনন্দিন কাজ, ঘুম এবং মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে, তাই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম কেন হয়?

হট ফ্ল্যাশ হলো হঠাৎ শরীর গরম অনুভব করা, মুখ চুলকানো বা লাল হওয়া, অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া ও অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তাপের অনুভূতি। অতিরিক্ত ঘাম হলে ঘুম ভেঙে যায় এবং ঘামের কারণে পোশক ও বিছানা ভিজে যায়।

নারীদের হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম কেন হয়, কী করবেন

এর প্রধান কারণ হলো এস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়া, যা মেনোপজের সময়ে স্বাভাবিকভাবে ঘটে। হাইপোথ্যালামাস - মস্তিষ্কের একটা অংশ - শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিন্তু হরমোন কমে গেলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের এই সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তাছাড়া অতিরিক্ত মানসিক চাপ, গরম পরিবেশ, মসলাযুক্ত খাবার, বেশি ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল গ্রহণ ইত্যাদির কারণে উপসর্গগুলি আরও তীব্র হতে পারে।

বাংলাদেশে উপসর্গ ও প্রকট রূপ

২০২২-২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে মেনোপজজনিত উপসর্গের প্রাদুর্ভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৮৩.২ শতাংশ নারী ‘হট ফ্ল্যাশ ও ঘাম’ উপসর্গের সম্মুখীন হয়েছেন এবং ৭১.৪ শতাংশ নারীর ঘুমের সমস্যা বেড়ে গিয়েছে।

আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯৬ শতাংশ নারী মেনোপজ পরিবর্তন চলাকালীন আচরণগত ও বিষণ্নতার মতো মানসিক পরিবর্তন অনুভব করেন।

কীভাবে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করবেন

মেনোপজের সঙ্গে হট ফ্ল্যাশ স্বাভাবিক নিয়মেই আসে। তাই এই প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ করা যায় না। তবে চেষ্টা করলে কষ্ট কমিয়ে আনা সম্ভব।

১. জীবনধারার পরিবর্তন: হালকা ও সুতি পোশাক পরুন, যা ঘাম শোষণ করবে। ঘরের ভেতর ভালো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন। সম্ভব হলে ঘরে পাখা বা এয়ার কুলার ব্যবহার করুন।

২. খাবার ও পানি: ক্যাফেইন, মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রচুর পানি পান করুন।

৩. মানসিক শান্তি: ধ্যান, যোগব্যায়াম বা পেশি শিথিল করার ব্যায়াম চর্চা করুন। ঘুমের রুটিন ঠিক রাখুন এবং রাতে ঘর ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করুন।

নারীদের হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম কেন হয়, কী করবেন

৪. চিকিৎসকের পরামর্শ: যদি উপসর্গ খুব বেশি হয় এবং ঘুম, দৈনন্দিন কাজ বা মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব ফেলে, তাহলে গাইনোকলজিস্ট-এর সঙ্গে পরামর্শ করে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা অন্যান্য ওষুধ বিবেচনা করা যেতে পারে।

৫. সচেতনতা: নিজের খেয়াল রাখার পাশাপাশি আপনার জীবনের এই পরিবর্তনের বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন। পরিবারের সহানুভূতি ও সচেতনতা খিটখিটে মেজাজ ও মানসিক উপসর্গে অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

হট ফ্ল্যাশ ও অতিরিক্ত ঘাম মেনোপজের স্বাভাবিক অংশ হলেও, প্রতিটি নারী তা ভিন্নভাবে অনুভব করেন। সচেতনতা বাড়িয়ে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে এসব উপসর্গ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তাই পরিবার ও সমাজের এ বিষয়ে কথা বলা এবং জানা খুব দরকার।

সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, নর্থ আমেরিকান মেনোপজ সোসাইটি ২০২৩ গাইডলাইন, জার্নাল অব মিড-লাইফ হেলথ ২০১৭, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, আইওএসআর জার্নাল, লিপিনকট জার্নাল

এএমপি/এএসএম

Read Entire Article