নিংসিয়ার আদর্শ স্কুল, জাদুঘর, কৌছি বেরি বাগান ও অন্যান্য

4 days ago 11

বাঙালি ভাত খায় তরকারি দিয়ে, আর চীনারা তরকারি খায় ভাত দিয়ে। নিংসিয়া এসে এ সত্যটা আরও ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছি। বাঙালির মূল খাবার ভাত, আর তরিতরকারি হচ্ছে অনুষঙ্গ; আর চীনাদের মূল খাবার হচ্ছে তরিতরকারি, ভাত হচ্ছে অনুষঙ্গ।

নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী ইনছুয়ানে এসেছি ৫ আগস্ট বিকেলে; চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) ও অন্যান্য গণমাধ্যমের একদল সাংবাদিক এবং সাধারণ বিদেশিদের মোটামুটি একটা বড় টিমের অংশ হিসেবে। তো, সেদিন রাতের ডিনার হলো হোটেল-লাগোয়া একটি হুই মুসলিম রেস্তোরাঁয়। গোল টেবিলে সাত-আট জন করে বসা যায়। ফলে একাধিক টেবিল লাগলো আমাদের। রেস্তোরাঁবালারা খাবার সার্ভ করা শুরু করলো। সবজির তরকারি, মাছের তরকারি, মাংসের তরকারি—একের পর এক আসতে লাগলো। আমরাও খাচ্ছি। সাথে নানান ধরনের স্যুপ আছে; আছে বিশেষ ধরনের ভেষজ চা। কোনো কোনো তরকারিতে নুডলস ভাসতে দেখা গেল। অনেক আইটেম থেকে খেতে খেতে পেট ফুল। সবশেষে দিল ভাত! তাই আমি বলি, চীনারা ভাত দিয়ে তরকারি খায়, তরকারি দিয়ে ভাত নয়। 

গত (৬ আগস্ট ২০২৫)-ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবার অন্য একটা মুসলিম রেস্তোরাঁয়। দুপুরের খাবারের সময় ভাত এলো সবার পরে। তখন পেটে আর জায়গা নেই। কিন্তু বাঙালির তো ভাত না-হলে চলে না! তাই দু’একটা লোকমা খেলাম। চীনারাও দেখলাম অল্প করে ভাত নিল। কেউ কেউ নিলই না। আমার ছেলেটা কিন্ডারগার্টেন থেকে চীনে আছে, এখানকার স্কুলে পড়াশোনা করে। সেও দেখি, এমনকি ঘরেও, তরিতরকারি যা আছে, তা আগে খেয়ে ফেলে। ভাত খায় সবার পরে, তরকারির ঝোল দিয়ে বা শুধু শুধু! একেই মনে হয় বলে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।

নিংসিয়ার আদর্শ স্কুল, জাদুঘর, কৌছি বেরি বাগান ও অন্যান্য
নিংসিয়ার খাবার

চীনাদের এই অভ্যাস সম্পর্কে শিশির একটা মজার তথ্য দিল আজকের ডিনারের সময়। রেস্তোরাঁয় যখন দল বেঁধে খাওয়া হয়, তখন ভাত সাধারণত শেষেই আসে। ভাত সার্ভ করা হয়েছে মানে আর নতুন কোনো আইটেম নেই! ডিনারের সময় ইন্টারেস্টিং আরেকটি ঘটনা ঘটে। সেটা ওয়াইন-সম্পর্কিত। অসাধারণ সুন্দর এক পরিবেশে, পাহাড়ের কোলঘেষে গড়ে ওঠা একটা হোটেলের রেস্তোরাঁয়, উন্মুক্ত আকাশের নিচে আমাদের সেই ডিনার ছিল এখন পর্যন্ত আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভোজ। তবে, সেই গল্প বলব আজকের লেখার শেষের দিকে।

৫ তারিখে এলেও, নিংসিয়ায় আমাদের সফর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় আজ, মানে ৬ আগস্ট। আর, কোনো সফর যদি শুরু হয় একটি অসাধারণ ও আধুনিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের মাধ্যমে, তাহলে তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। হোটেল থেকে গাড়িতে মাত্র ১০ মিনিটের পথ। বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটি ইনছুয়ান স্কুল দেখে আমি তো অবাক! বিশাল ক্যাম্পাস। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও এমন ক্যাম্পাস পেলে বর্তে যাবে। সুন্দর ছিমছাম, গোছানো। অনেকগুলো খেলার মাঠ, বিশাল লাইব্রেরি, সিনেমাহলের মতো বড় মিলনায়তন, অসংখ্য স্কুলভবন।

চীনে প্রাথমিক শিক্ষা ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত; মাধ্যমিক শিক্ষা সপ্তম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত; আর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। আমাদের দেশের মতো আলাদা করে কলেজ নেই এদেশে। হাইস্কুল পাস করে শিক্ষার্থীরা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়, যদি ‘কাওখাও’ নামের কঠিন ভর্তি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে। ইনছুয়ানের এই স্কুলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও হাই স্কুলের সবকটিই আছে। স্কুলে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আর ফুলটাইম শিক্ষকের সংখ্যা ১৯৮ জন।

নিংসিয়ার আদর্শ স্কুল, জাদুঘর, কৌছি বেরি বাগান ও অন্যান্য
মন দিয়ে চলচ্চিত্র দেখছে শিক্ষার্থীরা

স্কুলের প্রিন্সিপাল একজন নারী। তিনি আমাদের তার স্কুল সম্পর্কে নানান তথ্য দিলেন। স্কুলে চীনা ভাষা, ইংরেজি ভাষা, পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়নের মতো বিষয় ছাড়াও শেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম। স্কুল শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকবহির্ভুত কার্যক্রম তথা হবি বা শখ বিকাশেও সাহায্য করে। তাদের কেউ ছবি আঁকে, কেউ কাঠ দিয়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য তৈরি করে। স্কুল তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য একটা আলাদা গ্যালারি করেছে, যেখানে তাদের শিল্পকর্ম স্থান পায়।

অসাধারণ এক প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতের খাবার খাওয়ার স্বাদ আমরা সবাই নিতে পেরেছি। এখানে বলে রাখা ভালো, চীনারা সবসময় মুসলিমদের হারাম-হালালের ব্যাপারটি মাথায় রাখে। আমাদের টিমে মুসলিমরা সংখ্যালগিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও, প্রতিবার তাঁরা লাঞ্চ-ডিনারের জন্য মুসলিম রেঁস্তোরাই বেছে নিয়েছে এবং সফরে বাকি দিনগুলোতেও নেবে। থুরান্ত টাউনের ডিনারেও সকল খাবার ছিল হালাল। মাঝখানে ওয়াইন ‘কাবাবমে হাড্ডি’ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই ‘চেষ্টা’ সফল হয়নি।

স্কুলের বিশাল মিলনায়তনকে আসলে একটি সিনেমা হল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। সিনেমাহলের সব বৈশিষ্ট্যই এতে আছে। এই হলের বিশাল স্ক্রিনে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দেশে-বিদেশে নির্মিত সেরা চলচ্চিত্র দেখানো হয়। আমরা যখন মিলনায়তনে যাই, তখন একদল শিক্ষার্থী অপেক্ষা করছিল তেমন একটি চলচ্চিত্র দেখার জন্য। আসলে, শুধু ইনছুয়ানের এই স্কুলটিই নয়, গোটা চীনজুড়েই শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষার্থীবান্ধব করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ‘আনন্দের সাথে শিক্ষা’ হচ্ছে চীনের শিক্ষাব্যবস্থার একটা শ্লোগান। চীনের স্কুলগুলো যে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে বা উঠছে, তার প্রমাণ আমার ছেলে। বিগত ৬ বছরে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সে কখনও স্কুলে না-যাওয়ার বায়না ধরেনি। স্কুল তার কাছে আনন্দের জায়গা।

চীনে এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। লম্বা ছুটি, প্রায় দু’মাসের। শেষ হবে আগস্টের শেষ নাগাদ। কিন্তু এই ছুটিতে চীনা শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকে না, তারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়, বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। যেমন, ছুটি সত্ত্বেও, ইনছুয়ানের আলোচ্য স্কুলে একদল শিক্ষার্থী আজ এসেছিল বড় পর্দায় চলচ্চিত্র দেখতে। চীনের বিভিন্ন সিনেমাহলে এ সময় শিক্ষার্থীদের ভিড় দেখা যায়। লম্বা ছুটির সময় চীনা শিক্ষার্থীদের আরেকটি প্রিয় গন্তব্য জাদুঘর। অনেক স্কুল ছুটির হোমওয়ার্ক হিসেবে এক-দুটি জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে। তাই, শীতকালীন বা গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে চীনের বিভিন্ন যাদুঘরে তুলনামূলকভাবে ভিড় বেশি থাকে। নিংসিয়া যাদুঘর এর ব্যতিক্রম নয়।

আমাদের আজকের দ্বিতীয় গন্তব্য ছিল নিংসিয়া জাদুঘর। একটি প্রাদেশিক জাদুঘর হিসেবে বেশ বড়ই। ১৯৫৯ সালে এর যাত্রা শুরু হলেও, ১৯৭৩ সালে একে সরকারিভাবে ‘নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল জাদুঘর’ নামকরণ করা হয়। ২০০৬ সালে ২২ কোটি ৮০ লাখ ইউয়ান ব্যয় করে একে নতুন রূপ দেওয়া হয় এবং জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রায় ৪০ হাজার সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি প্রদর্শিত হচ্ছে এই যাদুঘরে। যথারীতি প্রচণ্ড ভিড়। দর্শনার্থীদের একটা বড় অংশ শিক্ষার্থী। জাদুঘর সামনে তুলে ধরছে অতীতকে, অতীতের মানুষকে, অতীতের সংস্কৃতিকে। বস্তুত, প্রতিটি জাদুঘর বর্তমানের সাথে অতীতের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। যতদূর জানি, চীনে সব জাদুঘর বিনে পয়সায় পরিদর্শন করা যায়। তবে, আগে থেকে অনলাইনে বুকিং দিতে হয়।

নিংসিয়ার আদর্শ স্কুল, জাদুঘর, কৌছি বেরি বাগান ও অন্যান্য
কৌছি বেরি বাগানে লেখক

যাদুঘরে অতীতচারণ শেষে বর্তমানে যখন ফিরলাম, তখন দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। হোটেলে ফিরে, লাঞ্চ সেরে, খানিকটা বিশ্রামের সময় পাওয়া গেল। এরপর, ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার বাসজার্নি করে পৌঁছালাম ‘পাইরুইইউয়ান উলফবেরি গার্ডেন হ্যলান মাউন্টেন বেইজ’-এ। চীনা ভাষায় উলফবেরি-কে ডাকা হয় ‘কৌছি বেরি’; দেখতে ও আকৃতিতে কিশমিশের মতো; রঙ লাল; স্বাদ টক-মিষ্টি। হ্যলান পর্বতমালার কোলঘেঁষে এই গার্ডেন। নিংসিয়ার কৌছি বেরি এর গুণগত মানের জন্য বিখ্যাত। আর এই খ্যাতি কাজে লাগিয়ে, বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে গার্ডেন। এখানে কৌছি বেরি বা উলফবেরি উৎপাদন করা হয়। শুধু তাই নয়, গোটা গার্ডেনকে একটি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। পর্যটকরা এখানে আসেন, চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে কৌছি চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেন, কৌছি’র স্বাদ গ্রহণ করেন।

গার্ডেনে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি মিনি জাদুঘর। এই যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে নিংসিয়ার সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিকভাবে উত্পন্ন কৌছি বেরি গাছ। যদিও সেটি এখন শুকিয়ে ‘মমি’ হয়ে গেছে। আমরা যখন গেছি, তখন ফসল তোলার মৌসুম নয়। জানলাম, জুনে ও অক্টোবরে ফসল তোলা হয়। গার্ডেনে একটি স্টোরও আছে, যেখানে নানান ধরনের কৌছি ও কৌছি থেকে তৈরি খাবার সরাসরি কেনা যায়। আমি সেখান থেকে চার প্যাকেট বিভিন্ন স্বাদের কৌছিজাত খাবার কিনলাম। দাম নিল ১০০ ইউয়ান। সুবিধা হচ্ছে, এগুলো আমাকে বহন করে বেইজিং নিতে হবে না। ওরাই ফ্রিতে পৌঁছে দেবে! আমি বেইজিংয়ে পৌঁছানোর আগেই সরাসরি কৌছি গার্ডেন থেকে বিশেষ খাবার পৌঁছে যাবে আমার ছেলের হাতে। আশা করি সে সারপ্রাইজড হবে।

কৌছি গার্ডেন অবস্থিত হ্যলান কাউন্টিতে। এই কাউন্টিরই চিনশান গ্রামে অবস্থিত দুলআন (Dulaan) টাউন। আমি ‘দুলআন’ লিখলেও, শুনেছি এর আসল উচ্চারণ ‘থুরান্ত’। কারণ, এটা ইতালি ভাষা থেকে এসেছে। ইতালির একটি অপেরার নাম থুরান্ত। অপেরার পরিচালক ইতালির হলেও, অপেরার বিষয়বস্তু নেওয়া হয়েছিল চীন থেকে। চীনের এক রাজকুমারীর গল্প অপেরায় উপস্থাপন করা হয়েছে। জানলাম, অপেরার পাত্র-পাত্রীরাও ছিল সবাই চীনা।

যাই হোক, থুরান্তকে টাউন বলা হলেও, এটা আসলে এখনও পুরোপুরি টাউন হয়ে ওঠেনি। চিনশানের ওয়াইন সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই নেওয়া হয়েছে বিশাল এই প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের প্রাক্কলিত মোট ব্যয় ১৫০ কোটি ইউয়ান (এক ইউয়ান=১৭ টাকা)। চিনশানে উন্নতমানের আঙুর উৎপাদন হয়, যা থেকে উন্নতমানের ওয়াইন পাওয়া যায়। থুরান্ত টাউনে বিপুল এলাকাজুড়ে আঙুর চাষ হচ্ছে, সেই আঙুর থেকে ওয়াইন উৎপন্ন হচ্ছে ও তা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়। প্রজেক্টটি যখন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে, তখন এটি হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র; এখানে থাকবে সাংস্কৃতিক ও সৃষ্টিশীল বুকস্টোর, ওপেন এয়ার থিয়েটার, ইত্যাদি। ইতোমধ্যেই এখানে গড়ে উঠেছে একটি বিলাসবহুল হোটেল কমপ্লেক্স। জানলাম, সবচেয়ে কম দামি একটি রুমের একদিনের ভাড়া ২ হাজার ইউয়ান।

নিংসিয়ার আদর্শ স্কুল, জাদুঘর, কৌছি বেরি বাগান ও অন্যান্য
হ্যলান পর্বতকে সামনে রেখে ভোজ

কমপ্লেক্সের একটা উঁচু প্লাটফর্ম থেকে ‘যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে’ দূরত্বে হ্যলান পর্বতমালা। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। আমরা যারা মুসলিম, তাদের কাছে ওয়াইন অস্পৃশ্য; কিন্তু ওয়াইনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকা এই টাউনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের কোনো তুলনা নেই; এখান থেকে দৃষ্টি ফেরানোর উপায় নেই। আমরা প্রাণভরে সেই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। হ্যলান পর্বতকে পেছনে রেখে, ছবি তুলতে ব্যস্ত হলাম আমরা। একসময় আমাদের জানানো হলো, আমাদের আজকের ডিনার হবে এখানেই, এই উন্মুক্ত আকাশের নিচে, হ্যলান পর্বতের সামনে!

আমার জন্য এটা সত্যিই একটা সারপ্রাইজ ছিল। এমন পরিবেশে বসে এক কাপ চা খেতে পেলেও আমি বর্তে যেতাম। সেখানে ডিনার! টিমের সবাই খুশি। কিন্তু গোল বাধলো সেই ওয়াইন নিয়ে! ডিনারের বড় বড় গোল গোল টেবিলে যত্ন করে সাজানো দামি ওয়াইনের বোতল। ওই টেবিলে বসে আমাদের ডিনার করতে হবে। কর্তৃপক্ষের কোনো দোষ নেই। ওয়াইনকেন্দ্রিক পর্যটনকেন্দ্রে অতিথিদের ওয়াইন দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। কৌছি গার্ডেনে আমাদের কৌছিজাত পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু উলফবেরি থেকে উত্প্ন্ন পানীয় আর আঙুর থেকে উৎপন্ন ওয়াইন তো আর এক না!

দলে আমরা চার-পাঁচজন মুসলিম। চীনা সহকর্মীদের মাধ্যমে আয়োজকদের কানে সমস্যাটা তোলা হলো। অনুরোধ করা হলো, যেন আমাদেরকে একটা আলাদা টেবিল দেওয়া হয়, যেখানে ওয়াইন বা ওয়াইনের বোতল থাকবে না। তাঁরা বিব্রত, আমরাও বিব্রত। এ অবস্থায় একটা সমাধান দিলেন আমাদের টিম লিডার। তিনি একটা টেবিল দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে যারা মুসলিম তাঁরা বসুন প্লিজ।’ পরিবেশকদের নির্দেশ দিলেন সেই টেবিল থেকে ওয়াইনের বোতল সরিয়ে নিতে। যেমন কথা তেমন কাজ। সেই টেবিলের ওয়াইনের বোতল উধাও হলো, সেখানে স্থান পেল অরেঞ্জ জুসের বোতল। কিন্তু টেবিলে তো আসন ডজনখানেক! বাধ্য হয়ে আমাদের চীনা সহকর্মীদেরও সেই টেবিলে বসতে হলো। শিশির তো আফসোস করে বলেই বসলো: ‘আমি এখানকার ওয়াইন একটু টেস্ট করতে চেয়েছিলাম!’

শিশির এই দফায় থুরান্ত টাউনের ওয়াইনের স্বাদ নিতে পারেনি। কিন্তু, অসাধারণ এক প্রাকৃতিক পরিবেশে রাতের খাবার খাওয়ার স্বাদ আমরা সবাই নিতে পেরেছি। এখানে বলে রাখা ভালো, চীনারা সবসময় মুসলিমদের হারাম-হালালের ব্যাপারটি মাথায় রাখে। আমাদের টিমে মুসলিমরা সংখ্যালগিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও, প্রতিবার তাঁরা লাঞ্চ-ডিনারের জন্য মুসলিম রেঁস্তোরাই বেছে নিয়েছে এবং সফরে বাকি দিনগুলোতেও নেবে। থুরান্ত টাউনের ডিনারেও সকল খাবার ছিল হালাল। মাঝখানে ওয়াইন ‘কাবাবমে হাড্ডি’ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই ‘চেষ্টা’ সফল হয়নি। (চলবে)

৬ আগস্ট ২০২৫, ইনছুয়ান, নিংসিয়া, চীন
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

Read Entire Article