নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’ দখলে নিতে চায় ছাত্রদল!

16 hours ago 6

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজের একটি কক্ষ জোর করে দখল করেছিলেন ছাত্রলীগের নেতারা। ওই কক্ষটি ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’ নামে পরিচিত। গত ৫ আগস্টের পর নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতারা পালিয়ে যাওয়ায় কক্ষটি তালাবদ্ধ রাখে কলেজ কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার পালাবদলে একই কক্ষটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন স্থানীয় ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা।

তাদের কথামতো কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কাজী ফারুক আহাম্মদ তালাবদ্ধ কক্ষের চাবি না দেওয়ায় শুরু হয় ঘটনার সূত্রপাত। একের পর এক ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এতে অধ্যক্ষসহ শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

কলেজ সূত্র জানায়, কলেজের ব্যবসায়িক শিক্ষা ভবনের ওই কক্ষটি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা জোর করে দখল করেছিলেন। কক্ষটি তারা ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এটি ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। এখন একই কক্ষটি দখলে নিতে চাচ্ছেন ছাত্রদল নেতারা। কক্ষের চাবি নিতে কলেজের অধ্যক্ষকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোক্তার হোসেন, ছাত্রদল নেতা নবী, নেওয়াজ শরীফ ও আলীফসহ কয়েকজন। কিন্তু কলেজের অধ্যক্ষ চাবি দিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এটি ভালোভাবে নেননি ছাত্রদল নেতারা। নেতারা ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি)।

ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রদল নেতা মোক্তার হোসেন, নবী, আমির হামজা, নেওয়াজ শরীফ ও আলীফের নেতৃত্বে বহিরাগতরা কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কলেজ ক্যাম্পাসে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন। মিছিল থেকে তারা অধ্যক্ষকে গালি-গালাজ করতে থাকেন। একপর্যায়ে অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকে হুমকি দিতে দিতেই অফিস কক্ষে তালা লাগিয়ে দেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধ্যক্ষ ওইদিন সরকারি কাজে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) ছিলেন। কলেজ থেকে ফোন পাওয়ার পর অধ্যক্ষ থানার ওসি মোহাম্মদ শিবিরুল ইসলামকে বিষয়টি জানান। ওসির কথায় ওইদিনই তারা অফিস কক্ষের চাবি ফিরিয়ে দেন।

পরদিন ছাত্রদল নেতা নেওয়াজ শরীফের নেতৃত্বে কয়েকজন এসে অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করেন। তারা কক্ষটির চাবি হস্তান্তর না করায় অধ্যক্ষকে হুমকি দেন। কিন্তু অধ্যক্ষ চাবি দিতে অস্বীস্কৃতি জানান। এতে আরও মেজাজ হারান নেতারা।

বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় কলেজ প্রশাসনের বিনা অনুমতিতে উপজেলা ছাত্রদল নেতা মোক্তার হোসেনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা কলেজ প্রাঙ্গণে মিছিল বের করেন। মিছিল শেষে ১২টায় কলেজ মাঠে কর্মী সম্মেলন শুরু করেন তারা। ওইদিন দুপুর ১টায় ছিল ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। ফলে সম্মেলন সংক্ষিপ্ত করতে বলে কলেজ প্রশাসন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করায় কলেজের অধ্যক্ষ পুলিশকে বিষয়টি জানান। খবর পেয়ে গফরগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম কলেজ প্রাঙ্গণে আসেন এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে কলেজে রেখে চলে যান।

কর্মী সমাবেশে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি শাকির আহমেদ, যুগ্ম-আহ্বায়ক রিসালাত ইসলাম সজিবসহ ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুবুর রহমান রানা, সাধারণ সম্পাদক আবু দাউদ রাইহানসহ অন্যান্য নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ছাত্রদলের কর্মী সমাবেশ চলে। এসময় কলেজ মাঠের একপাশে রোভার স্কাউট দীক্ষা অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিতরণী চলছিল। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মী সমাবেশ শেষে কেন্দ্রীয় ও জেলা ছাত্রদল নেতারা কলেজের গেট পার হওয়া সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদল নেতা মোক্তার হোসেন ও সুজনের নেতৃত্বে তাদের কর্মীরা রোভার স্কাউট দীক্ষা অনুষ্ঠানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এসময় লাঠিসোঁটা নিয়ে প্যান্ডেল ব্যাপক ভাংচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে অধ্যক্ষের দিকে দেড়ে আসেন তারা। শিক্ষকদের সহায়তায় কলেজের বিজ্ঞান ভবনের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নেন অধ্যক্ষ। ভাঙচুরের পর পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।

এসব ঘটনায় একাডেমিক কাউন্সিল ও শিক্ষক পরিষদের যৌথ সভায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন কলেজের শিক্ষকরা। যার নথি জাগো নিউজের হাতে এসেছে।

এতে দেখা যায়, মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ও বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুদিন অধ্যক্ষ অধ্যাপক কাজী ফারুক আহাম্মদের সভাপতিত্বে ও শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মো. আক্তারুজ্জামানের পরিচালনায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এসব ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এতে সই করেন কলেজের ৪৯ জন শিক্ষক।

কলেজের অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরীক্ষা থাকলেও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কলেজে প্রবেশ করে কর্মী সম্মেলন শুরু করে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও বিকেলে শান্তিপূর্ণভাবেই সম্মেলন শেষ হয়। তবে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতারা কলেজ গেট পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে রোভার স্কাউট দীক্ষা অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল ভাঙচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলে আমি শিক্ষকদের সহায়তায় দ্রুত দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নেওয়ায় রক্ষা পেয়েছি। এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষণে রেখেছি।’

তিনি আরও বলেন, “ব্যবসায়িক শিক্ষা ভবনের ওই কক্ষটি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। শত চেষ্টা করেও সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে কক্ষ থেকে সরানো যায়নি। ফলে কক্ষটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। ছাত্রদলের ওইসব নেতাদের হাতে চাবি হস্তান্তর না করায় আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে। এখন আমিসহ শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঘটনাটি পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাসহ সেনাবাহিনীকে জানিয়েছি।”

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘আমি চাই না গুটিকয়েক এসব ছেলেফেলের (ছাত্রদল নেতাকর্মী) জন্য দলের বদনাম হোক। এজন্য উপজেলার রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের ঘটনাগুলো জানিয়েছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গফরগাঁও উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা অনুমতি নিয়েই কলেজ মাঠে কর্মী সম্মেলন করেছি। তখন কেন্দ্রীয় ও ময়মনসিংহের ছাত্রদল নেতারা এলে গফরগাঁও উপজেলা, পৌর, পাগলা ও কলেজ ছাত্রদলের নেতারা উপস্থিত হন। শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলন শেষ হয়েছে। তবে প্যান্ডেল ভাঙচুর করার সঙ্গে আমাদের কোনো নেতাকর্মী জড়িত ছিলেন না। আমাদের বিরুদ্ধে তোলা অন্য সব অভিযোগও মিথ্যা ও বানোয়াট।’

স্থানীয় বিএনপি সূত্র জানায়, গফরগাঁও উপজেলা, গফরগাঁও পৌর ও পাগলা থানা কমিটি ৫ আগস্টে পর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। নেতাকর্মীরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। কলেজের বিষয়ে বক্তব্য জানতে পৌর বিএনপির একাধিক নেতাকে কল দিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এবি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘কলেজে বর্তমানে ছাত্রদলের কোনো কমিটি নেই। কমিটি যদি থাকতো তাহলে কলেজের কক্ষ দখল করে রাজনৈতিক অফিস বানানোকে কেউ ভালো দৃষ্টিতে দেখবেন না। পেশিশক্তির প্রয়োগ কেউ পছন্দ করেন না। কলেজের অধ্যক্ষকে হুমকি ও প্যান্ডেল ভাঙচুরের ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয়।’

তিনি বলেন, ‘নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী ছিল। এদের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জিম্মি ছিল। তাদের কর্মকাণ্ডের ফল এখন তারাই ভোগ করছে। আমরা চাই ছাত্রদল দুর্নাম নয়, সুনাম অর্জন করে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সবার আস্থা অর্জন করবে।’

ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মাহাবুবুর রহমান রানা বলেন, ‘আমরা খুব অল্প সময় মাইক ছাড়া কর্মী সম্মেলন করেছি। পরীক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। তবে ভাঙচুরের বিষয়টি আমার জানা নেই।’

ভাঙচুরের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন গফরগাঁও থানা পুলিশের সদস্যরা। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে গফরগাঁও সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজনীন আক্তার বলেন, পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ ঘটনায় অভিযোগ দিলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/এএসএম

Read Entire Article