নারায়ণগঞ্জের সংসদীয় আসনগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ-৪ (সদর উপজেলা) আসন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এই আসনটিতে একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল এ কে এম শামীম ওসমানের। তবে সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি।
ফলে এবারের নির্বাচনে আসনটিতে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। কিন্তু দলটির একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী। এর বিপরীতে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোতে রয়েছে একক প্রার্থী।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় থাকায় ফতুল্লা, এনায়েতনগর, বক্তাবলী, কাশীপুর, কুতুবপুর, গোগনগর ও আলীরটেক ইউনিয়ন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন গঠিত। এই আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩২৫ জন, যা জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আসনটিতে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে আবদুস সাত্তার, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে সিরাজুল ইসলাম, ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মোহাম্মদ আলী, ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী জয়লাভ করেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে টানা ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই আসন দখলে রাখেন আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে বিভিন্নভাবে নিজেদের জানান দিচ্ছেন। তবে তাদের মধ্যে এককভাবে মাঠে থাকা জামায়াতের প্রার্থী ও মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মো. আবদুল জব্বার বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বেশ আলোচনায় রয়েছেন।
আরও পড়ুন-
গাজীর আসনে বিএনপিতে প্রার্থীজট, সুসংগঠিত জামায়াত
আড়াইহাজারে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি
পাশাপাশি খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাও নির্বাচনী এলাকায় সরব রয়েছেন। সবাই যার যার অবস্থান থেকে নিজেকে জানান দিয়ে আসছেন। একইসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকেও অ্যাডভোকেট আল আমিন নামে একজনের নাম আলোচনায় রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। তিনি নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনেও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে পরাজিত করে গিয়াসউদ্দিন বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে রাতারাতি আলোচনায় এসেছিলেন।
জেলা বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলমও নির্বাচনী মাঠে আলোচনায় রয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও নাটকীয়ভাবে শেষ মুহূর্তে এসে ২০ দলীয় জোটের উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থী মনির হোসেন কাসেমীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তার আগে ২০০৮ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ শাহ আলম আওয়ামী লীগের প্রার্থী সারাহ বেগম কবরীর সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ২ হাজার ১০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।
এছাড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীব ও জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি দলের মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন।
আরও পড়ুন-
হারানো আসন ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি, মাঠে আছে জামায়াত-এনসিপি
আব্দুর রাজ্জাকের আসন পেতে মরিয়া বিএনপি-জামায়াত
মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘আমি আগেও জনপ্রতিনিধি ছিলাম। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উঠে এসে বিগত সময়ে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমি দুইটি আসন নিয়ে কাজ করছি। চেষ্টা করছি জনগণকে সম্পৃক্ত করে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার। সামগ্রিকভাবে সবার বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে আমি পুরো জেলার মধ্যেই কাজ করছি।’
জেলা বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবো। দীর্ঘ ১৭ বছর আমি দলের জন্য পরিশ্রম করে আসছি। ২০০৮ সালে নির্বাচন করেছি, আমাকে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করা হয়েছে এটা সবাই স্বীকার করে। তারপর ২০১৮ সালে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে কিন্তু জোটের স্বার্থে আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছে। এবারের নির্বাচনে দল আমাকে মনোনয়ন দিলে দলের পক্ষে নির্বাচন করবো। এই নির্বাচনের জন্য আমার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে।’
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেন, ‘স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে দলকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলাম, আশা করি দল আমার কাজের মূল্যায়ন করবে এবং মনোনয়ন দেবে।’
মামুন আহমেদ নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনেও বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী।
আরও পড়ুন-
বিএনপিতে আছে পিন্টু, চমক দেখাতে চায় জামায়াত-গণঅধিকার
কারাগারে লতিফ সিদ্দিকী, ভোটের মাঠে বিএনপি-জামায়াত
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীব বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ-৪ ও ৫ দুটি আসন থেকেই নেতাকর্মীরা নির্বাচন করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। দল আমাকে যেখানে মনোনীত করবে সেখানেই কাজ করবো। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমরা দলের জন্য কাজ করছি।’
জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো এবং মনোনয়ন পাবো। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে যারা মনোনয়ন চাইবেন বলে শুনছি তাদের কারো বাড়ি ফতুল্লায় না। আমি ফতুল্লা এলাকার বাসিন্দা। সে হিসেবে আমার গ্রহণযোগ্যতা বেশি।’
আরও পড়ুন-
আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি, চেষ্টায় জামায়াতও
জিততে মরিয়া বিএনপি, মাঠে জামায়াত, প্রতীকের অপেক্ষায় এনসিপি
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী মো. আবদুল জব্বার বলেন, ‘সংসদীয় এলাকায় আমরা বেশ সাড়া পাচ্ছি। জনগণ আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আমাদের দ্বারা যেসব কাজ করা সম্ভব সেসব কাজের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমরা মানুষের সেবক হবো। এরইমধ্যে আমরা অনেকগুলো সামাজিক কার্যক্রম করেছি।’
খেলাফত মজলিসের মনোনীত প্রার্থী ইলিয়াস আহমদ বলেন, “বিগত দিনগুলোতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের জনগণ ছিল উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। সাবেক এমপি ও তার সাঙ্গদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কাজে সবাই জিম্মি ছিলো। প্রচারণায় গেলে জনগণ নিজ থেকেই বলছে- ‘এই আসনে খেলাফত মজলিসহ ইসলামী দলগুলো একজন প্রার্থী দিতে পারলে তারা ব্যাপক সমর্থন দিয়ে বিজয়ী করবেন।’ আমরা নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী।”
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াই করা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসাইন কাসেমীও এবার আলোচনায় রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনেও আমি একই আসনে প্রার্থী হবো। আশা করি জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির সমর্থন আমার সঙ্গেই থাকবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আল আমিন বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি চলছে। আমি বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছি। জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করছি। আমাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ রয়েছে।’
এই আসনটিতে আল্লামা মামুনুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও তাদের মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির নারায়ণগঞ্জ মহানগর সহসভাপতি হাফেজ মাওলানা আবু সাঈদকে প্রার্থী ঘোষণা হলেও নির্বাচনী এলাকায় তার তেমন আলাপ শোনা যাচ্ছে না।
এফএ/এমএমএআর/এএসএম