জামালপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট পাওয়ার অহেতুক দেরির বিষয়টি এখন আর নেই বললেই চলে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বদলে গেছে এখানকার চিত্র। এখন নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট পাচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা। আগে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে অভিযোগের শেষ ছিল না। পাসপোর্ট সেবার এমন পরিবর্তন হলেও পুলিশ ভেরিফিকেশনে ঘুষের অভিযোগ আগের মতোই রয়েছে। পাওয়া গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দালালের অভিনব কৌশল গ্রহণের অভিযোগ।
সরেজমিন একাধিকবার পাসপোর্ট অফিস ঘুরে ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। কথা হয় জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ডিগ্রিরচর এলাকার রাজ্জাক, সফিকুল, রমজান, সোহেল ও আশরাফুলের সঙ্গে। তারা পাঁচজন একসঙ্গে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন। পেয়েছেনও একই দিনে।
এদের মধ্যে রাজ্জাক ছাড়া সবাইকে অপ্রাপ্ত বয়সের মনে হলে সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে গল্প করতে করতে জানা যায়, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ পাসপোর্টের জন্য নেওয়া হয়েছে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে ১১ হাজার টাকা। স্থানীয় ডিগ্রিরচর বাজারের কম্পিউটার অপারেটর সজিব মিয়া তাদের কাছ থেকে এ টাকা নিয়ে সব কাজ করে দিয়ে পাসপোর্ট প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, এনআইডি তৈরির জন্য জন্মসনদ লাগে। সেই জন্মসনদও ইউপি সদস্যের সহযোগিতায় সংগ্রহ করে দেন ওই সজিব মিয়া।
কথা হয়, জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা কলেজছাত্র ফাহিমের সঙ্গে। তিনি জানান, তার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে পাসপোর্ট অফিসের অদূরে এক কম্পিউটারের দোকানি সব কাজ করে দিয়েছেন। এজন্য তার কাছ থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ পাসপোর্ট অফিসের খরচ দেখিয়ে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।
একসময় অফিসের আশপাশের কম্পিউটারের দোকানি, স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি পাসপোর্ট অফিসে দালালি করলেও বর্তমানে জেলার বিভিন্ন উপজেলা শহরে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের কম্পিউটারের দোকানিরা সাধারণ মানুষের পাসপোর্ট করতে বিভিন্ন কায়দায় অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
পাসপোর্ট অফিসে সেবাপ্রার্থী যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই পুলিশ ভেরিফিকেশনে টাকা লাগে বলে জানিয়েছেন। তবে এককালীন চুক্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকায় সব কাজ শেষ করে দেওয়ার ঘটনা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেগুলোতে। জন্মসনদ, এনআইডি এবং পাসপোর্ট সব কাজ শেষ করে দেওয়ার চুক্তি নেয় দালাল চক্র।
খোঁজ নিতে ইসলামপুর উপজেলার ডিগ্রিরচর বাজারে গিয়ে পাওয়া যায় সজিবকে। তিনি প্রথমে সব অস্বীকার করলেও পরে কিছু খরচ নেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
সজিব জানান, সব জায়গায় কাজ করার লোক থাকে। আমি তাদের মাধ্যমে এলাকার মানুষের কাজ করে দিই। আমি কোনো অফিসে যাই না। এনআইডি তৈরির জন্য নির্বাচন অফিসে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ করে সজিব বলেন, সব অফিসেই কাজ করার লোক থাকে। টাকা না দিলে তাড়াতাড়ি কাজ হয় না বলে জানান তিনি। তিনি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে কোনোভাবেই রাজি হননি।
একসময় পাসপোর্ট অফিসে দালালদের অবাধ বিচরণ থাকলেও এখন তা নেই। সর্বজন পরিচিত জামালপুর শহরের এক দালালকে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও তিনি প্রায়ই অফিসে গিয়ে কর্মকতাদের বিরক্ত করেন বলে জানান কর্মকর্তারা।
পাসপোর্ট অফিসের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় জামালপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. তানভীর আনজুমের সঙ্গে। তিনি জানান, একজন ব্যক্তির সাধারণ পাসপোর্ট পেতে যেসব কাগজপত্র লাগে, তা থাকলে আমরা পাসপোর্ট দিতে বাধ্য। নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট বিতরণ করতে যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নির্ধারিত সময়ের আগে আঞ্চলিক অফিসে পাসপোর্ট পৌঁছে গেছে এমন তথ্য তিনি তার অফিসিয়াল কম্পিউটার থেকে দেখান কালবেলার প্রতিনিধিকে। সেবাপ্রার্থীরা যাতে সঠিক সহযোগিতা পান সেজন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে বলে জানান তানভীর।
তরুণ কর্মকর্তা তানভীর কালবেলাকে জানান, কোথায় ঘুষ দেয় জনগণ সেটা তার জানার সুযোগ নেই। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তারা জনগণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। কেউ যদি বাইরে কোনো দালালের খপ্পরে পড়েন তাহলে তাদের কী করার আছে?
তিনি জানান, পাসপোর্ট অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশের বিশেষ শাখার বিরুদ্ধে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় জামালপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ রফিকুল ইসলামের কাছে।
সৈয়দ রফিক কালবেলাকে জানান, বিশেষ শাখার অর্ধেকের মতো কর্মকর্তা বদলি হয়েছে সরকার পরিবর্তনের পর। নতুন পুরোনো মিলে কাজ চলছে। পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের নামে কেউ যদি ঘুষ নেয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা সময় নেব। এ সময় তিনি সব ধরনের অনিয়ম রুখতে সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার জন্য বলেন।