বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তার জবানবন্দি দিয়েছেন।
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রপক্ষের ৩৭তম সাক্ষী হিসেবে তিনি এই জবানবন্দি পেশ করেন।মোহাম্মদ হাসান চট্টগ্রাম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
জবানবন্দিতে মোহাম্মদ হাসান জানান, গত ১৮ জুলাই, ২০২৪ সালে চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ এলাকায় আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে তিনি পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। আমার পিঠে মোট ১১টি গুলি লেগেছিল। পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তাররা ৮টি গুলি বের করেন, কিন্তু ৩টি গুলি এখনো আমার শরীরে রয়ে গেছে। এসময় তিনি ট্রাইব্যুনালের সামনে তার পিঠের গুলির ক্ষতচিহ্নও দেখান।
তিনি জানান, ২০২৫ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম টাইগার পাস এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। এছাড়াও, তিনি মুরাদপুর, নতুন ব্রিজ এবং কক্সবাজারের চকরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, ১৬ জুলাই দুপুরে মুরাদপুরে আন্দোলন চলাকালে যুবলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি, হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, শৈবাল দাস সুমন এবং সাবেক মেয়র আ.জ.ম নাসিরসহ আরও অনেকে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এসময় নুরুল আজিম রনির হাতে পিস্তল, হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের হাতে শর্টগান ও অন্যান্যদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের একটি দল ষোল শহরের দিকে চলে যায়। আমরা কয়েকজন মোহাম্মদপুরের একটি গলিতে আশ্রয় নিই।
সেখানেই আমি জানতে পারি যে, আক্রমণকারীদের গুলিতে আমাদের সহকর্মী ফয়সাল আহমেদ শান্ত নিহত হয়েছেন। একই সময়ে, আমি আরও জানতে পারি যে সন্ত্রাসীরা ওয়াসিম আকরাম নামের একজন আন্দোলনকারীকে কুপিয়ে এবং ফারুক নামের একজন কাঠ মিস্ত্রিকে গুলি করে হত্যা করেছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা বাসা থেকে বের হয়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাই। পরে আমি ফয়সাল আহমেদ শান্তর লাশ দেখতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই, কিন্তু পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।
- আরও পড়ুন
- গুলি করবি না কেন? তোদের চাকরি খেয়ে নেব, বলেন এডিসি আক্তার
- ‘আনাসকে গুলি করার দৃশ্য চোখে দেখেছি, আমার কপালেও গুলি লাগে’
- আবু সাঈদ হত্যা মামলায় তৃতীয় দিনের সাক্ষ্য চলছে
মোহাম্মদ হাসান জানান, এরপর ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, আমি আরও পাঁচ-ছয়জন বন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেই। সেখানে প্রায় দুই হাজার আন্দোলনকারী উপস্থিত ছিল। পুলিশ আমাদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছুঁড়লে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। সেই সময়েই পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যরা আমাদের দিকে শর্টগান দিয়ে গুলি করে। এতে আমি পিঠে গুলিবিদ্ধ হই।
তিনি বলেন, আমার পিঠে মোট ১১টি গুলি লেগেছিল। প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে চাইলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ আমাকে বাধা দেয়। পরে আমি একটি রিকশা নিয়ে পার্কভিউ হাসপাতালে যাই। সেখানকার ডাক্তাররা আমার শরীর থেকে ৮টি গুলি বের করতে পারলেও ৩টি এখনো রয়ে গেছে। আমার পিঠের ক্ষতচিহ্ন এখনো বিদ্যমান।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত এই যোদ্ধা বলেন, আমি এই হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার, অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দায়ী করছি। আমি আল জাজিরা এবং বিবিসি-র মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ওপর Lethal Weapon (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এফএইচ/কেএইচকে/জিকেএস