পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘সাংবাদিকদের ভুল তথ্য’ বিশ্লেষণ চলছে

2 months ago 9

পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় যেসব সাংবাদিক ভুল তথ্য দিয়েছিলেন তাদের বক্তব্যও আমরা গ্রহণ করেছি। সেই বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, তখন খবরের কাগজে কী প্রকাশিত হয়েছিল, টেলিভিশনে কী প্রচার হয়েছিল এবং বইয়ে কী লেখা হয়েছিল- সবকিছু পর্যালোচনা চলছে।

বুধবার (২৫ জুন) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের তৃতীয় সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, যারা বিদেশে অবস্থান করছেন তারা সবাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন। তাদের অনেকের সঙ্গে জুমের মাধ্যমে অনলাইনে কথা বলেছি।

চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যরা কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছেন, রাস্তা অবরোধও করছেন। তাদের দাবি চাকরি পুনর্বহাল করতে হবে, বিডিআর নাম পুনর্বহাল করা এবং তদন্ত কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এসব বিষয়ে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ভাবনা কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং শাস্তি হয়েছে তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য কিংবা অবস্থান নেই। তবে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না তা জানার জন্য জেলখানায় যেসব সৈনিক আছেন বন্দি অবস্থায় তাদের সাক্ষ্য আমরা গ্রহণ করেছি। এগুলো বিচার-বিশ্লেষণ চলছে।

‘১৬ বছর পরে এসে আমরা তদন্ত শুরু করি। এই লম্বা সময়ে অনেকের কাছে থাকা অনেক তথ্য হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। এজন্য সঠিক তদন্তে সময়ের প্রয়োজন। বাইরের কোনো চাপ নেই আমাদের।’

তৎকালীন গোয়েন্দা কর্মকর্তা যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় দায়িত্বে থাকা ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রধানরাই নন, তখনকার অনেক কর্মকর্তার বক্তব্য আমরা নিয়েছি। সেসময় গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে নিয়েছি।

তিনি বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দুইটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদন আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে দেখছি তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য জঙ্গিবাদকে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া মাদরাসার ছাত্রদের ব্যাপকভাবে (৩৫ শতাংশ) বিডিআরে নেওয়া হয়েছে এমন কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়। কিন্তু আমরা দেখছি ১২ শতাংশের বেশি নয়। এই ধরনের বিষয়গুলো সেখানে নিয়ে এসে তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ওই সময় করা হয়েছিল।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে তদন্ত কমিশনের সভাপতি বলেন, বাইরে যারা পালিয়ে আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমি চিঠি দিয়েছি। যা প্রক্রিয়াধীন।

আপনারা কতটুকু স্বাধীন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, গেজেট অনুযায়ী আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘সাংবাদিকদের ভুল তথ্য’ বিশ্লেষণ চলছে

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চলাকালে কিছু গণমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে বিদ্রোহ উসকে দিয়েছিল। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে সামরিক অফিসারদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস চালিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিদেশি সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কমিশন মনে করে যে সময়মতো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যেত।

১৫৮ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ
সংবাদ সম্মেলনে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি বলেন, এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৫৮ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। আরও আনুমানিক ৫০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি আছে। ৮ জন সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের সাক্ষাৎকার জেলে নেওয়া হয়েছে। তিনজন উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। দুজন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম ই-মেইলে জবানবন্দি দিয়েছেন।

তদন্ত কমিশন জানায়, এখন পর্যন্ত শহীদ পরিবারের ছয়জনের বিস্তারিত জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। সব শহীদ পরিবারের সদস্য নিয়ে দুটি সম্মেলন করা হয়েছে। সেখানে তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যক্ত করেছেন। সম্মেলনে সব ইচ্ছুক সদস্যদের লিখিত বা কমিশনে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত জবানবন্দি দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অনেক শহীদ পরিবারের সদস্য এরই মধ্যে তা করেছেন। বেঁচে ফিরে আসা ১৫ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ জন বেঁচে যাওয়া অফিসারের লিখিত জবানবন্দি প্রদান করার জন্য সেনাসদরের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দুটি সম্মেলনে তাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে মতবিনিময় হয়েছে।

তদন্ত কমিশন জানায়, ৫৫ জন সামরিক অফিসার, যারা বিভিন্নভাবে পিলখানা ট্র্যাজেডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন একাধিক সাবেক সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর প্রধান; বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

কমিশন আরও জানায়, ২০ জন অসামরিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, আমলা, আগের তদন্ত কমিটির সদস্য, তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা। ৯ জন বেসরকারি ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি। যাদের কাছে ঘটনাসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। কারাগারে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫ জন বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তারা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সে সম্পর্কে নানান ধরনের তথ্য দিয়েছেন। যেগুলো এখন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আরও সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। এর বাইরে ২৯ জন কারামুক্ত বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।

৩৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
তদন্ত কমিশন জানায়, প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ ও তদন্ত কার্যক্রমে অধিকতর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কমিশন ৩৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পলাতক ব্যক্তিদের সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কমিশন তিনটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

টিটি/কেএসআর/জিকেএস

Read Entire Article