পুঁজিবাজারে শিবলী-রিয়াজ আজীবন নিষিদ্ধ

3 hours ago 6

 

স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ড থেকে তালিকাচ্যুত পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১০৯ কোটি টাকার বেশি জরিমানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সেইসঙ্গে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামকে পুঁজিবাজারের কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত ৯৭৮তম কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিশন সভা শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম।

বিএসইসির পরিচালক আবুল কালাম জানান, স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ড থেকে তালিকাচ্যুত পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডের ৫১ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণের নিমিত্ত ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার ২৮৯ দশমিক ৪৮ টাকা দরে ক্রয়ের মাধ্যমে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড পরিচালিত ৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড, এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড এবং গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়।

এ বিনিয়োগের সময় পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ছিল না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির প্রতি শেয়ারের নেট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) ছিল নেগেটিভ ২ দশমিক ৭৪ টাকা এবং নেগেটিভ রিটেন আর্নিং ছিল ২ দশমিক ৩৫ কোটি টাকা (৩০ জুন ২০২২ অনুযায়ী)।

এ বিনিয়োগের অব্যবহিত আগে ডিএসইর ওটিসি প্ল্যাটফর্মে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের ট্রেডিং প্রাইস ছিল ১৩ দশমিক ৬০ টাকা। পরবর্তীতে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো থেকে মনোনীত পরিচালকের (যারা ফান্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় বরং এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের স্বার্থপুষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে কোম্পানিটির বোর্ড গঠন করা হয় এবং কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে ‘কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড’ নামকরণ করা হয়।

একই সঙ্গে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা হতে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এই ৬টি ফান্ড হতে প্রতিটি শেয়ার ১৫ দশমিক ৮৮ টাকা মূল্যে মোট ৪৫ দশমিক ০২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এ সময় কোম্পানির বিদ্যমান পূর্বতন শেয়ারহোল্ডারকে কোনো শেয়ার দেওয়া হয়নি। এছাড়া উল্লিখিত ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন প্রকাশ করা হয়নি, ইজিএম করা হয়নি এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা শেয়ার লক ইন করা হয়নি।

উল্লিখিত ৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে না থাকা এমন লোকসানি কোম্পানিতে ৬৮ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ইউনিটহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান বিএসইসির মুখপাত্র।

এর মধ্যে রয়েছে-
প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন ১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক প্রাইস সেনসেটিভ ইনফরমেশন প্রকাশ না করা, ইজিএম না করা এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা শেয়ার লক ইন না করার মাধ্যমে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের তৎকালীন পরিচালক রিয়াজ ইসলাম, রেজাউর রহমান সোহাগ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আহসান (অব.), মদিনা আলী, সৈয়দ কামুরুল হুদা এবং মো. ওমর সয়েব চৌধুরী-এর প্রত্যেককে কোটি টাকা করে অর্থদণ্ড আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা এই ৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড হতে বিধিবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ করা অর্থ সুদসহ মোট ৯০ কোটি টাকা ফান্ডগুলোর বিনিয়োগের অনুপাতে ৩০ দিনের মধ্যে এই ৬টি ফান্ডে ফেরত আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম এই অর্থ ফান্ডগুলোতে ফেরত আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ফান্ডগুলোতে এই সময়ের মধ্যে এ অর্থ ফেরত আনতে ব্যর্থ হলে অর্থদণ্ড প্রদানের আদেশের তারিখ থেকে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ও সিইও রিয়াজ ইসলাম-কে ৯৮ কোটি টাকা এবং পরিচালক মি. জর্জ এম. স্টককে এক কোটি টাকা ও পরিচালক রেজাউর রহমান সোহাগকে এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১' এর বিধান ভঙ্গ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে না থাকা এবং এনএভি ও রিটেন আর্নিং নেগেটিভ এমন দুর্বল কোম্পানির একক শেয়ারে বিনিয়োগ করায় এই ৬টি ফান্ডের ইউনিট-হোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। এ প্রেক্ষিতে জনস্বার্থে ৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের নিয়োগ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

উল্লিখিত ৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের যথাযথ তদারকি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে ইউনিট-হোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড-কে ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মিথ্যা তথ্য প্রদান করায় কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান রেজাউর রহমান সোহাগকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের ৩০ জুন ২০২৩ তারিখে সমাপ্ত আর্থিক বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় নিরীক্ষক শফিক বশাক অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিষয়টি ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (এফআরসি) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

একই সময়ে ৩টি প্রতিষ্ঠান- সোনালি সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ডের তৎকালীন পরিচালকের দায়িত্বে থাকায় সৃষ্ট স্বার্থের সংঘাত থাকার কারণে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আহসাকে (অব.) এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা তৎকালীন পদ্মা প্রিন্টার্স অ্যান্ড কালার লিমিটেডে বিনিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন এবং কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধন ১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করার বিষয়টি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় অনৈতিক যোগসাজশ থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামকে পুঁজিবাজারের কার্যক্রম থেকে আজীবন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড কর্তৃক প্রতিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার প্রতিটি ৫২ দশমিক ২৫ টাকা করে মোট ২৪ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেডে বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শেয়ার মূল্যায়ন করেছে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্স লিমিটেড। সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্স লিমিটেডের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদ হোসেন ও এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামের যোগসাজশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই শেয়ার মূল্যায়ন করা হয়। ওই শেয়ার মূল্যায়নের মাধ্যমে কোয়েস্ট বিডিসি লিমিটেড থেকে ২৪ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেডে হস্তান্তরিত হয়, যার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হওয়ায় বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এমএএস/এমএএইচ/

Read Entire Article