দুর্নীতি মামলার আসামি অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আঞ্চলিক পরিচালক পদে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুই একদিনের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবে দুদক।
পাশাপাশি পুতুলকে ডব্লিউএইচও’র আঞ্চলিক পরিচালক বানাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কোনো হস্তক্ষেপ আছে কী না তা খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রোববার (১৯ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এ তথ্য জানান।
পুতুলকে নিয়ে দুদকের পদক্ষেপ বিষয়ে জানতে চাইলে আক্তার হোসেন বলেন, প্লট দুর্নীতিতে পুতুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরই মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা তার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেবেন। পুতুলের বিশ্ব স্বাস্থ্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান দল তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। তারা অভিযোগ প্রমাণে সহায়ক সবার বক্তব্যে নেবেন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন দপ্তরে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হবে। তার দুর্নীতির বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক। সেই বিষয়বস্তু উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুই মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে।
গত ১৫ ডিসেম্বর পুতুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সংস্থাটির অভিযোগ পত্রে বলা হয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ পান।
দুদকের তথ্য বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক পরিচালক বানাতে তার ক্ষমতাকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। কোনো কারণ ছাড়াই মেয়েকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী করেছেন।
পুতুলের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে যেসব অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা উল্লেখ করা হয়েছে, তা কেবল কাগুজে ও ফরমায়েশি। পুতুলের সব অযোগ্যতাকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মেয়ে পুতুলকে সঙ্গে করে ভারত নিয়ে যান। একইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭৬তম সম্মেলন উপলক্ষে দিল্লিতে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় করে শতাধিক কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিদল উপস্থিত হয়।
পুতুল নিজের পারিবারিক প্রভাব এবং তার নিকটাত্মীয়দের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের বিপুল অর্থ ক্ষতিসাধন করেছেন এবং একই সঙ্গে তাদের কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রীয় সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করে দুদক।
পুতুল দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এবং তার মায়ের রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছিলেন বলেও দুদকের নথিতে উঠে এসেছে।
গত ২০২৩ সালের নভেম্বরে ভারতের নয়াদিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কমিটির ৭৬তম অধিবেশনে সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক নির্বাচিত হন সায়মা ওয়াজেদ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দায়িত্ব নেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দপ্তর ভারতের দিল্লিতে। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পুতুল সেখানেই আছেন। এছাড়া বেআইনিভাবে ঢাকার পূর্বাচলে নিউটাউন প্রকল্পের ডিপ্লোম্যাটিক জোনে দশ কাঠা প্লট করায়ত্ত করেন। সেকারণে তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা রুজু করেছে দুদক।
পুতুল ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামীয় একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে উপঢৌকন নিতেন বলে দুদকের অভিযোগে উল্লেখ আছে। এছাড়া তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে ফাউন্ডেশনের নামে প্রাপ্য অর্থ করমুক্ত করিয়ে নেন। যাতে সরকারের বিপুল অর্থের ক্ষতিসাধন হয়েছে। এ অপরাধের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে কমিশন।
দুদকে নথিতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের আওতায় অটিস্টিক সেলকে ব্যবহার করে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে পুতুল নিজে লাভবান হয়েছেন।
দুদকের ওই কর্মকর্তা বলেন, পুতুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। এহেন ব্যক্তি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সম্মানজনক পদে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া দেশের জন্য মর্যাদা হানিকর। বিশ্ব-মণ্ডলে দেশের সুনাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। পুতুলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদ বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠিটি পাঠানো হবে।
এসএম/এমএএইচ/