বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে ডিপ্লোমা শেষ করেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার পারসিধাই গ্রামের শিমুল। চাকরি দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করলেও হাঁসের খামারে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলেন। তাতে ১৮ লাখ টাকা লোকসান হয়। এরপর ইউটিউবের ভিডিও দেখে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ নামের পোকা চাষে অনুপ্রাণিত হন। এতেই ভাগ্য বদলেছে তার। এখন গড় মাসিক আয় প্রায় ২ লাখ টাকা। শিমুলের ব্যাপক সফলতায় বাড়ছে খামারের সংখ্যা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর ডিপ্লোমা কোর্স করেন শিমুল। এরপর ঢাকায় চাকরি দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন। ছোট চাকরি ও আয়ে আপত্তি ছিল তার। ফলে চাকরি ছেড়ে ২০১৮ সালে বাড়িতে বাণিজ্যিকভাবে হাঁস পালনের খামার গড়েন। এতেও সফল হতে পারেননি। উল্টো লোকসানে ঋণের দায়ে জর্জরিত হন। ১৮ লাখ টাকা ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়।
হঠাৎ ইউটিউবে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নামের পোকা চাষের ভিডিও দেখেন শিমুল। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পোকা চাষে প্রথম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে চাষপদ্ধতি ও বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পান। এ ছাড়া পাবনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রোগ্রাম ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (পিসিডি) থেকেও নতুন করে প্রশিক্ষণ নেন। ঋণ, প্রযুক্তিগত ও সংশ্লিষ্ট বাজারে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে শিমুলকে সহায়তা দেয় সংস্থাটি। এরপর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ে পোকা চাষে অনুকরণীয় উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন শিমুল। ভালো উৎপাদন ও দামে মাত্র ৩ বছরে ১৬ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি কক্সবাজার ও পাবনাসহ তিনটি খামারের মালিক হন তিনি।
শিমুল জানান, শক্ত খোলসযুক্ত মূল পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে দিনের বেলা আলো-বাতাস আসে এমন জায়গায় রাখা হয়। পোকাগুলো প্রজনন সম্পন্ন করার পর সেখানে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো হ্যাচিং করে ফোটানোর ৮-১০ দিন পর আলাদা করে অন্য জায়গায় রাখা হয়। সেখান থেকে তৈরি হয় লার্ভা। ২০-৩০ দিনের মধ্যে লার্ভাগুলো দেখতে পোকার মতো হয়। যা মাছ, হাঁস বা মুরগিকে খাবার হিসেবে দেওয়া হয়। ২০-৩০ দিন পর লার্ভাটি থেকে গেলে তা মাছিতে পরিণত হয়। একেকটি প্রাপ্তবয়স্ক মাছির জীবনকাল হয় ৮-১০ দিন। মুরগির নাড়িভুড়ি পচা, জীবিত মাছ বা যে কোনো ধরনের নষ্ট বর্জ্য লার্ভার খাবার হিসেবে দেওয়া হয়।
এ উদ্যোক্তা জানান, ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানে ব্ল্যাক সোলজার মাদার পোকা রপ্তানি করেছেন তিনি। এ ছাড়া এসব পোকা বিক্রি করেন স্থানীয় ও ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে। এভাবে শিমুল এখন কক্সবাজারে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় বড় আকারের ফার্ম করছেন।
আরও পড়ুন
বন্যা থেকে বাঁচিয়ে চরাঞ্চলের কৃষকদের অভিনব সবজি চাষ
রেজাউলের দুগ্ধ খামারের বায়োগ্যাসে চলে রান্নার কাজ
সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অভিব্যক্তি জানিয়ে শিমুল বলেন, ‘শুরুতে এই পোকা চাষের উদ্যোগ নিলে অনেকেই আমাকে নিয়ে উপহাস করতেন। ঘৃণাও করতেন কেউ কেউ। এখন সফলতা দেখে সেটি তেমন দেখান না। আসলে ধৈর্য ও পরিশ্রমে সফলতা আসবেই। হাঁস পালনে লোকসান হলেও ধৈর্য ও পরিশ্রমে পোকা চাষে সেই সফলতা মিলেছে।’
তথ্য বলছে, দেশে হাঁস-মুরগির খামার আছে প্রায় ৬০ হাজারের মতো। মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে এসব খামার। এর খাদ্য সহায়ক হিসেবে দেশের ২৫ জেলায় ২৮০ জনের বেশি উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই নামের পোকা চাষ করছেন। মাসে প্রায় ৭০ টনেরও বেশি পোকা উৎপাদন করেন তারা। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডানিডাসহ বিভিন্ন সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় এই পোকা চাষের উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করেছে বিভিন্ন সংস্থা। এদিকে এই পোকা ফিশারিজ ও পোল্ট্রি শিল্পের জন্য আগামীতে আশীর্বাদ হবে বলে জানান পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞরা। ব্যাপক প্রোটিনসমৃদ্ধ এই খাবার খাওয়ালে কম খরচে মাছ ও পোল্ট্রির উৎপাদন বাড়বে। এর মাধ্যমে বায়োটেকনোলজি, সার ও ভালো প্রোটিন পাওয়া যাবে। এই পোকা পরিবেশবান্ধব।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল বলেন, ‘প্রচলিত বাজারে মাছ ও পোল্ট্রি খাবারের প্যাকেটে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে। কিন্তু এই পোকায় প্রোটিনের পরিমাণ ৪৩-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণে দেশে ক্রমেই মাছ ও পোল্ট্রির খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে এই পোকা। এর উৎপাদন খরচও কম। ১ কেজি পোকার উৎপাদন খরচ ১০-১২ টাকা। প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৫০-৮০ টাকা।’
বেসরকারি সংস্থা পাবনা পিসিডির নির্বাহী পরিচালক মো. শফিকুল আলম বলেন, ‘শুরু থেকেই শিমুলের পাশে আমরা থেকেছি। প্রশিক্ষণ, ঋণ ও প্রযুক্তিসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা আমরা দিয়েছি। এসবের ফলে তার সক্ষমতা বা দক্ষতার জায়গা আরও বৃদ্ধি হয়েছে। পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় শিমুল এই পোকা উৎপাদনে আজ দেশসেরা হয়ে উঠেছেন।’
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসইউ/এএসএম