প্রতিমা তৈরিতে ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি বাজেট

2 hours ago 5

পাবনার বেড়া উপজেলার নাকালিয়ার বাসিন্দা ধনঞ্জয় পাল। ৪০ বছর ধরে পাবনার বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিমা তৈরি করেন তিনি। এবছরও কারিগরসহ ৬ জন লেবার নিয়ে ৯টি মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন। তার বানানো সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রতিমার বাজেট ১ লাখ টাকা। পাবনা শহরের পাথরতলার রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম মন্দিরের জন্য এ প্রতিমাটি বানানো হয়েছে। এখন বাকি রঙ ও ফিনিশিংয়ের কাজ। একই অবস্থা বাকি ৮টি প্রতিমার ক্ষেত্রেও।

দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে প্রায় আড়াই মাস ধরে চলা তাদের ব্যস্ততার এবার বিদায় নেওয়ার পালা। এসময় পারিশ্রমিকে খুশি হওয়ার কথাও তাদের। কিন্তু সেই খুশির ছাপ নেই তাদের মুখে। উল্টো শোনা গেলো অসহায়ত্বের গল্প।

ধনঞ্জয় পাল জানান, আগের মতো লাভ নেই প্রতিমা তৈরিতে। দিন দিন মণ্ডপগুলোর বাজেট কমছে। তুলনামূলক সুনিপূণ কারুকাজ না হলেও কম বাজেটে পূজা সম্পন্ন করাটাই যেনো মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বড় কারণ প্রতিমা তৈরিতে ব্যয় বৃদ্ধি। গত দশ বছরে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু আয় বাড়েনি। ফলে দুর্দশায় নিমজ্জিত হচ্ছে পেশা।

লাখ টাকা বাজেটের প্রতিমার খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই প্রতিমায় এক লাখ টাকার চুক্তি নিয়েছি। এরমধ্যে কমপক্ষে ৪৫-৪৮ হাজার টাকার কাঠই লেগেছে। মাটি লেগেছে সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার টাকার। এরপর খড়, কাপড় ও রঙসহ অন্যান্য খরচ রয়েছেই। তাতে উপকরণবাবদ সবমিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচই হয়ে যাবে। বাকি যা থাকবে ওরমধ্য থেকে লেবার বিল ভাগাভাগি করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে এক লাখ টাকা ইনভেস্ট করে লাভ তেমন কিছুই থাকে না।

প্রতিমা তৈরিতে ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি বাজেট

ধনঞ্জয় পাল বলেন, একটা প্রতিমা বানাতে প্রায় ১০ দিন সময় লাগে। লেবার লাগে প্রায় ৪০-৫০টি। সর্বনিম্ন ৮০০ টাকার লেবার আছে আমার এখানে। এর কমে লেবার মেলে না। আর কারিগরকে দিতে হয় ১২০০ টাকা। সঙ্গে খাওয়া দাওয়াতো আছেই। ১০ বছর আগের তুলনায় খরচ অনেক বেশি। লেবার প্রতি ৩০০-৫০০ টাকা বাড়তি। এই পেশায় আমাদের টিকে থাকাই এখন মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০-২৫ বছর আগেও এ পেশার কদর ও আয় ছিল।

তিনি বলেন, শুধু প্রতিমা নয়, সবক্ষেত্রেই বছর দশেক ধরে পালদের একেবারে নাজেহাল অবস্থা। কম দামি, সহজলভ্য প্লাস্টিক ও স্টিলের পণ্য ব্যবহারে মানুষের অতিরিক্ত ঝোক এর বড় কারণে বলে মনে করেন তিনি।

প্রতিমা তৈরির আরেক কারিগর দেবেশ পাল। তিনি জেলার আমিনপুর থানার সাগরকান্দি ইউনিয়নের গোবিন্দপুরের বাসিন্দা। ৩০ বছর ধরে পাবনা শহর, আটঘরিয়া, ঈশ্বরদী, সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কাজ করেন। দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে এবছরও ৫ জন শ্রমিক নিয়ে পাবনা শহরের রাধানগর, শালগাড়িয়া ও গোপালপুরসহ বেশকিছু এলাকার প্রায় ১৫টি মন্দিরে আপন মহিমায় প্রতিমা তৈরি করছেন তিনি। মাটির কাজ শেষে এখন রঙের কাজ শুরু করেছেন। আলাপকালে জানালেন প্রতিমা তৈরির বিচিত্র গল্প।

তবে এ পেশায় ১০ বছর আগের ও এখনকার আয়ের সঙ্গতির গল্পে এসে কিছুটা আটকে গেলেন দেবেশ পাল। জানালেন রঙিন সেই গল্প আর নেই এই পেশায়। নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর তুলনায় প্রতিমা তৈরিতে বাজেট বাড়েনি। ফলে আয় কমে ব্যাপক সংকটে এ পেশা।

আরও পড়ুন-

নারায়ণগঞ্জে ২২৪ মণ্ডপে পূজার প্রস্তুতি, চার স্তরের নিরাপত্তা
শারদীয় দুর্গাপূজা: ফটিকছড়ির ১২৭ মণ্ডপে পুরোদমে চলছে প্রস্তুতি
উপকরণের দাম বাড়লেও আয় বাড়েনি প্রতিমা কারিগরের

দেবেশ পাল জানান, এ বছর সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা বাজেটের একটি প্রতিমা বানাচ্ছেন তিনি। এ প্রতিমা তৈরিতে খড়, কাদামাটি, কাপড়, বাঁশ-কাঠ ও রঙে খরচ হবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এরপর লেবারের মজুরি দিতে লাগবে ১৫-২০ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, এ পেশায় আর ভাত নাই। বাপ-ঠাকুরদারা এই কাজ করতেন। তাদের কাজের সময় খেলার ছলে কাঁদামাটি ছেনতে ছেনতে (নাড়তে) এ কাজে ঢুকে পড়ি। পরে আর কোনো কাজ শেখা হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে এই কাজই করছি।

এ পেশা এখন বিলুপ্তির পথে জানিয়ে দেবেশ পাল বলেন, ১০ বছর আগে ৬০ হাজার টাকার একটি প্রতিমা বানালে খরচ হতো সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। লেবার বিল দিয়ে প্রায় অর্ধেকের বেশি টাকাই লাভ হতো। এখন সেটি নেই। ৩০০ টাকার রং হয়েছে ৬২০ টাকা ও ৫০০ টাকার মাটি এখন হয়েছে ১৫০০ টাকা। এভাবে সবকিছুতে দ্বিগুণেরও বেশি খরচ বেড়েছে। কিন্তু প্রতিমা তৈরির বাজেট তেমন হারে বাড়েনি।

প্রতিমা তৈরিতে ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি বাজেট

এ দশা শুধু মুল কারিগরদের নয়। এ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরও। নির্মাণ ব্যয় বাদে অবশিষ্ট যা থাকে তা থেকে যা মজুরি বা পারিশ্রমিক মেলে সেসব দিয়ে এই উচ্চমূল্যের বাজারে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন বলছেন তারা।

এ ব্যাপারে শ্রমিক ভজন পাল বলেন, দু’বছর ধরে পূজায় প্রতিমা তৈরির কাজ করি। প্রতিমার বাজেট না বাড়ায় অল্প মজুরি বা হাজিরায় কাজ করতে হয়। এ বছর দিনে ৫০০ টাকা হাজিরায় কাজ করছি। এই টাকায় সংসার চালানে কঠিন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতেও পারি না ঠিকমতো।

তিনি বলেন, এইতো পূজার কাজ শেষ। এখন আবার গ্রামে গিয়ে দইয়ের খুঁটিসহ মাটির জিনিস বানানোর কাজে লাগতে হবে। কিন্তু ওগুলোতেও শান্তি নাই। মাটির জিনিসি বেচাকেনা একদমই হয় না। একারণে কাজ সব সময় থাকে না। পূজার সময় যদি একটু বেশি আয় হতো তাহলে সবমিলিয়ে হয়তো আরেকটু ভালো চলতে পারতাম।

পূজা উদযাপন পষিদের তথ্যমতে, পাবনা জেলায় এ বছর ৩৪৫টি মন্দির বা মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে পাবনা সদরে ৫১টি, ঈশ্বরদীতে ৩০, আটঘরিয়ায় ১৫, চাটমোহরে ৫২, ফরিদপুরে ১৭, ভাঙ্গুড়ায় ২১, বেড়ায় ৬৩, সাঁথিয়ায় ৪১ ও সুজানগরে ৫৫টি মণ্ডপ রয়েছে।

এসব মন্দিরে শেষ সময়ের প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে পূজা উপযাপন পরিষদ পাবনা জেলা শাখার সভাপতি প্রভাস কুমার ভদ্র বলেন, মন্দিরগুলোতে প্রতিমা তৈরিসহ নানা ব্যস্ততা চলছে। উৎসবমূখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। এরইমধ্যে জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ তারা সবধরনের সহযোগিতা করছে। মন্দির প্রতি ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রশাসন মন্দিরের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। আমরা নিজেরাও মন্দিরের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার কাজ করছি। এখনো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) মো. মশিউর রহমান মন্ডল বলেন, দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে জেলায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। এরইমধ্যে মন্দিরগুলো নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা সম্ভাবনা ও সুযোগ নেই।

এফএ/এমএস

Read Entire Article