অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
রোববার (১৯ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ওয়েবসাইটে ওই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে।
চিঠিতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশে মানবাধিকার, নিরাপত্তা খাত সংস্কার, বিচারিক জবাবদিহি এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনগুলো।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী সংগঠনগুলো হলো- এইচআরডব্লিউ, বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজের অধিকার রক্ষায় কাজ করা দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক সংস্থা সিভিকাস, রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন থাইল্যান্ডভিত্তিক ফোরটিফাই রাইটস, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর সংগঠনগুলো তাদের ফলো-আপ চিঠিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও সতর্ক করে বলেছে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বাহিনী সংস্কার ছাড়া টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তা মতপ্রকাশ, সংগঠন ও সমাবেশের মৌলিক স্বাধীনতাকে অতিরিক্তভাবে সীমিত করছে।
আরও পড়ুন
আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা নেই
দেশের বাইরে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছি: প্রেস সচিব
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না: সালাহউদ্দিন
সংগঠনগুলো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তারা জাতিসংঘের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টের কথাও উল্লেখ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, কোনো বড় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে এবং ভোটারদের বড় অংশকে বঞ্চিত করবে।
চিঠিতে সংগঠনগুলো আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেছে। তারা বলেছে, নিরাপত্তা খাত সংস্কার এখন সবচেয়ে জরুরি, বিশেষ করে র্যাবকে বিলুপ্ত করা এবং ডিজিএফআইয়ের ক্ষমতা সীমিত করে এমন এক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। এছাড়া তারা গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়।
মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৫, বিশেষ ক্ষমতা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিতকারী আইনগুলো বাতিল বা সংশোধনেরও তাগিদ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।
সংগঠনগুলো সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এবং এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা সংস্কার করে নাগরিক সমাজের স্বাধীন কার্যক্রম নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
তারা আরও বলেছে, মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো বন্ধ রাখতে হবে এবং ক্যাম্পে চলাচল, জীবিকা ও শিক্ষায় আরোপিত সীমাবদ্ধতা শিথিল করতে হবে।
চিঠিতে মৃত্যুদণ্ডে স্থগিতাদেশ জারি, গুম অপরাধকে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে প্যারিস নীতিমালা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে, নির্বাচনের আগে এই অল্প সময়ের মধ্যে যদি অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বহুত্ববাদ, নাগরিক স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়, তবে বাংলাদেশ আবারও দমন-পীড়নের চক্রে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
জেপিআই/ইএ/জিকেএস