প্রেমের চিঠি এখন অতীত, যা আসে আইনি-তালাক নোটিশ

3 hours ago 4

• আধুনিকতায় বদলে গেছে যোগাযোগের ধরন
• বেশিরভাগ চিঠিই এখন তালাক-আইনি নোটিশ সংক্রান্ত
• কিছু চিঠি দাপ্তরিক
• আগের মতো কদর নেই পোস্টম্যানদের

‌‘তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা....।’ আবার ‘বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের ‘মতিহার’, বাদল রাতের বুকের বন্ধু’—প্রেম, দ্রোহ ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের হৃদয় নিঙড়ানো অনুভূতিতে লেখা দুটি চিঠির অংশ এগুলো।

প্রথমটি কবি তার স্ত্রী নার্গিসকে ও দ্বিতীয়টি কবির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীকে লেখা পৃথক দুটি চিঠির অংশ। চিঠিতে কবির প্রতি স্ত্রীর অনুযোগ-অভিযোগের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি অতীতের কিছু মধুর স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। একইভাবে বন্ধু মতিহারকে নিয়েও স্মৃতিচারণ করেছেন কবি।

দুটি চিঠিই উনিশ শতকের শুরুর দিকে লেখা। এখন বিংশ শতকের প্রথমার্ধ। প্রিয়জনের কাছে চিঠি লিখে মনের ভাবাবেগ প্রকাশের ফুসরত নেই মানুষের। আধুনিকতায় বিশ্বব্যাপী গতিময়তা বৃদ্ধিতে যান্ত্রিক মানুষদের কাছে এখন এসব চিঠি চালাচালি ‘ব্যাকডেটেড’ বিষয়ে রূপ নিয়েছে।

এখন হলুদ বা রঙিন খামে প্রিয়জনকে লেখা চিঠি আসে না পোস্টম্যানের কাছে। আসে দাপ্তরিক, আইনি ও বিচ্ছেদ বা তালাকের নোটিশ সংক্রান্ত চিঠি। এখন এসবে ভারী হওয়া ব্যাগ টানেন পোস্টম্যানরা। রঙিন খামের চিঠি এখন শুধুই অতীত।

পাবনার চর আশুতোষপুর অবিভাগীয় শাখা পোস্ট অফিসের পোস্টম্যান রেজাউল। তিনি জাগো নিউজকে জানান, শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন বাদে ইদানীং দিনে গড়ে ১০-১৫টি সর্বোচ্চ ২০টি চিঠি বিলি করেন তিনি। এগুলোর মধ্যে ১০টির মতো থাকে বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আইনি নোটিশের চিঠি। পাঁচটির মতো বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক সংক্রান্ত নোটিশ। বাকি কয়েকটি দাপ্তরিক অন্যান্য নোটিশ বা চিঠি।

পাবনা সদর উপজেলার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম। ডাকনাম আশরাফ। তিনি পেশায় সরকারি চাকরিজীবী। বাবা সেনাবাহিনীতে দাপ্তরিক চাকরির সুবাদে কৈশোরের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন রাজধানীর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। পরিবারের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের স্টাফ কলোনিতে থাকার সময় বন্ধুত্ব হয় দুই বছর বেশি বয়সী শিমুলের সঙ্গে। শিমুলের বাবাও ওই ক্যান্টনমেন্টে আশরাফের বাবার সঙ্গে একই সেকশনে চাকরি করতেন।

১৯৯৬ সালের শেষের দিকে হঠাৎ আশরাফের বাবার রংপুরে বদলি হলে আশরাফ ও শিমুলের দুই বছরের বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে। বিষয়টি নিয়ে আশরাফের ব্যাপক মন খারাপ হলেও যোগাযোগের সহজ কোনো মাধ্যম পাচ্ছিলেন না। কারণ তখন ফোনের এত সহজলভ্যতা ছিল অকল্পনীয়। মন খারাপের পর্দা টানতে বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টায় আবেগ-অনুভূতি মিশিয়ে একটি চিঠি লেখেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও সে চিঠির জবাব না আসায় আরও মেঘ জমে আশরাফের মনে। প্রশ্ন করে নিজেকেই—তবে কি শিমুল চিঠি পেলো না? নাকি তাকে ভুলে যাওয়ায় চিঠি পেয়েও উত্তর দিলো না শিমুল?

প্রেমের চিঠি এখন অতীত, যা আসে আইনি-তালাক নোটিশ

আশরাফের বর্ণনামতে, এমন সব প্রশ্নে তার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো। এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন শিমুলের চিঠি আসে। এরপর এক বছরের বেশি সময় ধরে তাদের বন্ধুত্ব জীবিত থাকে চিঠির কথায়। তাদের দুজনের প্রিয় নায়ক-নায়িকা ছিল বাংলা সিনেমার সালমান শাহ ও শাবনূর। চিঠির সাথে প্রিয় নায়ক-নায়িকার ভিউ কার্ড পাঠাতেন একে অপরকে। এরমধ্যে হঠাৎ আবার শিমুলের চিঠি আসা বন্ধ হলো। পরপর দুটি চিঠি লিখেও জবাব মেলেনি। পরে জানা যায়, শিমুলের বাবারও অন্যত্র বদলি হয়েছেন। সম্ভবত সে কারণেই চিঠি পাননি শিমুল, উত্তরও দেননি।

আশরাফ জানান, চিঠি নিয়ে শুধু একটি নয়, আছে বহু স্মৃতির সম্ভার। মামির বোনের মেয়ের সঙ্গে এখন সংসার তার। দুই ছেলে ও এক মেয়ে তাদের ঘরে। এর আগে মামার বাসায় বেড়াতে আসতেন স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। এরপর গ্রামের বাসায় বেড়াতে আসেন তার স্ত্রী সেলিনা। তাকে সাইকেলে করে গ্রামের মেঠোপথ ঘুরে বেরিয়েছেন। পাবনা শহর ও আশপাশের বিভিন্ন জায়গাতেও ঘুরেছেন তারা। তখনও তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়নি।

এরপর সেলিনা রাজবাড়ী জেলার নিজ বাড়িতে গেলে কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৪ সালের দিকে এ যোগাযোগ নতুন করে স্থাপন হয় চিঠির মাধ্যমে। চিঠিতে সাধারণ খোঁজখবর নেওয়া ও ভাব আদান-প্রদান শুরু হয়। এরপর চিঠি চালাচালি ও ফোনালাপের মাধ্যমে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক।

চিঠি প্রসঙ্গে আশরাফ বলেন, ‘সেসময় চিঠি ছাড়া যোগাযোগের বিষয়টি ভাবার উপায় ছিল না। আমরা শখেও চিঠি লিখতাম। বইয়ে দেখেছি, কবি নজরুল ও রবীন্দ্রনাথসহ বিভিন্ন গুণীজনদের লেখা চিঠিসমৃদ্ধ, সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এটি আমাদের ওই প্রজন্মের অনেকের কাছেই আকর্ষণের ছিল। শুধু আকর্ষণ নয়, চিঠি দিয়ে আমাদের সচেতনতামূলক কাজের নজিরও রয়েছে। আমরা বন্ধুরা যদি দেখতাম, কোনো ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে আরেকটি ছেলে বা মেয়ের সখ্য বাড়ছে বা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এদের একজন ভালো নয় বা ক্ষতিকারক নেতিবাচকতা রয়েছে; তাহলে বিপরীতজনকে বেনামে চিঠি দিয়ে আমরা বন্ধুরা অনেক সময় সতর্ক করেছি। শুধু ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, যে কোনো পরিচিত মানুষের ক্ষেত্রেও এমনটি করা হয়েছে। এতে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু এখন এসব কিছুই নেই।’

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চিঠি বা জ্ঞানমূলক বইয়ের পাতা রেখে এখন সবাই ফেসবুকে দিন পার করছেন। আধুনিক বিশ্বে এখন সময় নিয়ে চিঠি লেখে না। বিভিন্ন অ্যাপের অ্যাকাউন্ট থেকে টুং টাং শব্দে মেসেজ আদান-প্রদান হচ্ছে। তাইতো পোস্টম্যান বা পিয়নের কাছে এখন আর রঙিন খামে চিঠি আসে না।’

কথা হয় চর আশুতোষপুর অবিভাগীয় শাখা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার (ইডিএ) মো. আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে পোস্ট বিভাগে রয়েছি। সেসময় অফিসিয়াল চিঠির পাশাপাশি স্বজন বা প্রিয়জনদের উদ্দেশেও অনেক চিঠি আসতো। কিন্তু এখন এসব তেমন দেখা যায় না। আমার শাখার অধীনে চরাঞ্চলের ৮-১০টি এলাকার অনেক গ্রাম। এসব এলাকার সব চিঠি এখান থেকে ছাড়া হয়। বছর পনেরো বিশেক আগেও ৮০০ থেকে হাজারের মতো চিঠি আসতো। ইদানীং মাসে গড়ে ৪০০-৫০০ চিঠি আসে। এগুলোর প্রায় সবই আইনি নোটিশ ও তালাক সংক্রান্ত। অল্পকিছু দাপ্তরিক চিঠি আসে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন চিঠি বলতেই আইনি ঝামেলার বার্তা। সেটি হোক ঋণ বা তালাক সংক্রান্ত। এর ফলে এসব চিঠিতে আগ্রহ নেই প্রাপকদের। ফলে পিয়ন বা পোস্টম্যান বাসায় চিঠি নিয়ে গেলে তাদের আর আগের মতো আপ্যায়ন বা সম্মানও দেখানো হয় না। অথচ একটা সময় ছিল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পোস্টম্যানদের ডেকে চিঠি আছে কি-না জিজ্ঞেস করা হতো। খুশি মনে পোস্টম্যানদের দেওয়া হতো বকশিশ। এসবই এখন বইয়ের পাতায় স্থান পাওয়া অতীত।

পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘ছাত্রজীবনে আমরা বহু চিঠি লিখেছি। চিঠি নিয়ে পত্র সাহিত্য নামে সাহিত্যের একটি শাখা রয়েছে। খ্যাতনামা লেখকদের সেসময়কার লেখা চিঠিগুলো তাতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সাহিত্যের এ শাখায় আর নতুন কোনো রচনা যুক্ত হওয়ার তেমন সম্ভাবনা দেখা যায় না। কারণ এখন চিঠি লেখার প্রচলনের রূপান্তর ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী কর্মে গতি বেড়েছে। ফলে চিঠি আদান-প্রদানের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এখন আর কেউ জড়াতে চান না। তবে ভাব আদান-প্রদান থেমে নেই। রূপান্তরিত আধুনিক পদ্ধতিতে প্রযুক্তির মাধ্যমে মনের আকুতি একজন আরেকজনকে জানাচ্ছেন। এজন্য ডাকবক্সগুলো খালি পড়ে থাকে। এতে কেউ চিঠি দেন না।’

প্রেমের চিঠি এখন অতীত, যা আসে আইনি-তালাক নোটিশ

তিনি বলেন, ‘আধুনিকতা চর্চাকে মন্দ বলবো না। তবে চিঠি লেখার এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হলেও দু-একটি করে চিঠি লেখা বা আদান-প্রদান করা উচিত। ক্লাসেও শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে তাগিদ দেওয়া উচিত। কেননা এখান থেকে লেখালেখির যে চর্চা সেটি হতে পারে। এরমধ্য দিয়ে মনের আকুতি বা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশে স্বকীয়তা বা সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পেতে পারে।’

পাবনা ডেপুটি জেনারেল পোস্টমাস্টারের কার্যালয়ের অধীনে রয়েছে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার ৩৮৪ টি পোস্ট অফিস। এরমধ্যে ১৮ টি উপজেলা, ১৭টি বিভাগীয় সাব পোস্ট অফিস, ১১টি অবিভাগীয় সাব পোস্ট অফিস ও ৩৩৮ টি অবিভাগীয় শাখা পোস্ট অফিস রয়েছে। এসব অফিসের অন্যান্য পদের পাশাপাশি একজন করে পোস্টম্যান রয়েছেন। কোনো কোনো অফিসে একাধিক ব্যক্তিও পোস্টম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

একইভাবে পাবনা হেড পোস্ট অফিসের অধীনে পাবনা পৌর বা শহর এলাকায় ৯টি পোস্ট অফিস রয়েছে। এসব পোস্ট অফিসে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার চিঠি আদান-প্রদান হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে পাবনা হেড পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার বিপ্লব কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসব অফিসে একটি করে ডাকবাক্স রয়েছে। নিয়মিত খুলে দেখলেও খুব একটা চিঠি এসব বক্সে মেলে না। রঙিন খাম বা ব্যক্তিগত চিঠি তো দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে প্রায়। তবে কয়েক বছরের তুলনায় চিঠির সংখ্যা বেড়েছে। এগুলো সবই বিজনেস লেটার অর্থাৎ মামলা মোকদ্দমা বা আইনি, দাপ্তরিক ও তালাকের নোটিশ সংক্রান্ত চিঠি।

এসআর/এএসএম

Read Entire Article