ফেনীতে ৪১০ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আলোচিত বিশালাকার প্রাচীন গাছ ‘মেঘ শিরিষ’। চারপাশে ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে গাছটি। ফেনী শহরের ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডে কড়ই গাছের অবস্থান। ফেনী-সোনাগাজী সড়কের দাউদপুর সেতু সংলগ্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছটিতে প্রতিদিনই অসংখ্য পাখি ভিড় জমায়। এখনও গাছটি দেখতে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা।
জানা যায়, ১৫৪০-১৫৪৫ সালের দিকে শের শাহ ‘সড়ক এ আজম’ নামে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময়ে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ঘোড়ার মাধ্যমে যাতায়াত করতো। সেই সময়ে ট্রাঙ্ক রোডের পাশে বিভিন্ন স্থানে বিশ্রামের জন্য এসব গাছ রোপণ করা হয়। কালক্রমে সব গাছ মারা গেলেও কড়ই গাছটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ফেনী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তথ্যমতে, মেঘ শিরিষ স্থানীয়দের কাছে কড়ই গাছ নামে পরিচিত। এ ছাড়া এটি বিলাতি শিরিষ বা রেইন ট্রি কড়ই নামেও পরিচিত। গাছটির ইংরেজি নাম রেইন ট্রি। গাছটি আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ নয়। মেঘ শিরিষের আদি নিবাস মেক্সিকো ও ব্রাজিল। ধারণা করা হয়, পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে এ গাছের আগমন ঘটে।
মেঘের সঙ্গে এ গাছের নিবিড় সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। মেঘ জমতে শুরু করলে এ গাছ পাতাগুলো গুটিয়ে নেয় এবং বৃষ্টির আভাস দেয়। হয়তো এ কারণে গাছটির নাম হয়েছে মেঘ শিরিষ। এ ছাড়া গাছের তলা প্রায়ই ভেজা দেখা যায়। কখনো বৃষ্টি না হলেও ভেজা থাকে। এটি বৃষ্টির কারণে নয়। গাছতলা ভেজা দেখার কারণে ‘রেইন ট্রি’ নামকরণ হয়েছে।

রেইন ট্রি গাছ সাধারণত ৫০-৮০ ফুট লম্বা হয়। এটি ছাতা-আকৃতির মুকুট তৈরি করে। খোলা জায়গায় দেখতে পাহাড়ের মতো মনে হয়। রাস্তার পাশে ছায়াতরু হিসেবে বিশেষ খ্যাতি আছে। এ চিন্তা থেকে ব্রিটিশরা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড সংস্কার করার সময় রাস্তার পাশে অনেকগুলো রেইন ট্রি গাছ লাগিয়েছিল। ধারণা করা হয়, গাছটিও সেই সময়ের। এর আনুমানিক বয়স ৪১০ বছর। ২০২২ সালে কয়েকজন শিক্ষার্থী গাছটির ব্যসার্ধ পরিমাপ করেন। তাতে প্রায় ৭.৩ মিটার পাওয়া যায়।
কয়েক বছর আগে প্রাচীন গাছটিকে রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করে বিভিন্ন সংগঠনের দুই শতাধিক সদস্য। তারা গাছটিকে ফেনীর ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করে ‘বিজ্ঞাপনমুক্ত’ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তারা গাছটি রক্ষা করে এর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ফেনী পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে বছরজুড়ে গাছটিতে পেরেক দিয়ে বিভিন্ন প্রচার ও বিজ্ঞাপন লাগানো থাকতো।
আরও পড়ুন
স্বামী নিগমানন্দের আশ্রম: আধ্যাত্মিক শান্তির আশ্রয়
টাঙ্গুয়ার হাওরের জলে ভেসে ভেসে
গাছটি সম্পর্কে এলাকার শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘পূর্বপুরুষদের কাছে এ গাছের সম্পর্কে আমরা অনেক গল্প শুনেছি। গাছটির নিচে একসময় দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভ্রমণার্থীরা রাতযাপন করতেন, বিশ্রাম নিতেন। তখন আশপাশের অভিজাত ব্যক্তিরা বিশ্রামার্থীদের আদর-আপ্যায়নের আয়োজন করতেন।’
শহরের উকিলপাড়ার বসিন্দা রহমান মিয়া বলেন, ‘আমরা শুনেছি এটি বাংলার প্রথম রাজা শের শাহের আমলে পত্তন করা হয়েছে। জন্মের পর থেকেই গাছটিকে এভাবেই দেখে আসছি। বাবার বাবাও গাছটি দেখেছিলেন। গাছটি সম্পর্কে দাদা-নানারা অনেক কিচ্ছা-কাহিনি শোনাতেন আমাদের।’
গাছটির নিচে ৫০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন কুমিল্লার শ্রী অভিলাশ কর্মকার। গাছটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই গাছটি দেখে আসছি। একসময় এখানে দোকানপাট কিছুই ছিল না। কোনো মানুষ আসতে সাহস পেত না। ফেনী নদী থেকে প্রবাহিত একটি ডোবার অবস্থান ছিল। কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে। এখন অনেক দোকানপাট হলেও গাছটি আগের মতোই রয়ে গেছে। গাছটি নিয়ে নানা কাহিনিও শুনেছি।’

ফেনী সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোশারফ হোসেন মিলন বলেন, ‘গাছে কতগুলো ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ জন্মে। এগুলো গাছের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং বার্ড নেস্ট ফার্ন নামে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের মরে যাওয়া পাতা বিভিন্ন পাখির বাসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।’
তিনি বলেন, ‘দুঃখের বিষয় ফেনীর ঐতিহাসিক রেইন ট্রি গাছের পরিচর্যা করতে গিয়ে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ পরিষ্কার করার সাথে সাথে পাখিদের আবাসস্থলও ধ্বংস করেছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কোনো বিষয়ে ধারণা না থাকলে যারা ধারণা রাখেন, তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া উচিত। একটি গাছ শুধুই গাছ নয়, যার সাথে পুরো একটি ইকোসিস্টেমের অনেকগুলো প্রাণের সম্পর্ক।’
এসইউ/জিকেএস

1 hour ago
6









English (US) ·